14/03/2024
মা সর্বমঙ্গলা
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
বর্ধমান শহরের উপর দিয়ে প্রায়ই আমাকে যাতায়াত করতে হয়, কিন্তু ঐতিহ্যপূর্ণ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ, প্রাণোচ্ছল এই গুরুত্বপূর্ণ শহরের অভ্যন্তরে মনোঃসংযোগ করার মতো তেমন সুযোগ আমার আসেনি।
কিন্তু সেই সুযোগ ও মাহেন্দ্রক্ষণ আনয়নের কারিগর , যার আবেদনে সাড়া না দিয়ে আমরা তিনটি প্রাণী নিমরাজিতে ও রাজি হয়ে গেলাম, সে হলো আমাদের সর্বজনবিদিত ,অবসরপ্রাপ্ত, মিষ্টভাষী সুব্রত মান্না। সাড়া দিয়েছিলাম বর্ধমানে জি,টি রোড়ের ওর পৈতৃক বাড়িতে একবার ঘুরতে যাবার জন্য। ভ্রমণ পিপাসু হিসেবে রজতদা,সুশান্তদা ও আমার যতটা খ্যাতি থাকুক না কেন অতিথি আপ্যায়ণে সুব্রত মান্নার যে কতখানি সুনাম তা ওর বর্ধমানের বাড়িতে পদার্পণ না করলে কখনোই অনুভব করার সুযোগ পেতাম না।
আমাদের তো আবার "উঠলো বাই তো কটক যাই।"
মান্নার নির্দেশ মতো যথা সময়ে স্টেশনে ৬ নং প্লাটফর্মে হাজির হয়েছিলাম তিনজন।
মান্না টিকিট কেটেই রেখেছিল। মান্নাকে নিয়ে আমরা চারজন বিখ্যাত "সীতাভোগ"আর "মিহিদানার" শহর বর্ধমানের দিকে রওনা দিলাম। লোক্যাল ট্রেনের জানালার কাছে বসেই চারজন শুরু করলাম অফিস পাড়ার সেই স্মৃতি রোমন্থন।
একঘন্টা ও কাটেনি হঠাৎ মান্না ব্যাগ থেকে সকালের জলখাবার বের করতে আরম্ভ করলো। কাগজের প্লেট, টিস্যুপেপার আর ফুলকো ফুলকো লুচি তরকারী । আঃ কি স্বাদ ! মান্নার মিসেসের হাতের রান্নার তুলনা করতে হলে তাহলে ভজহরি মান্নাকে টেনে আনতে হবে। মান্নার মেয়েরাও নাকি খাবার বানাতে হাত লাগিয়েছিল। মা, আর মেয়েরা মিলে আমাদের জন্য যে উপাদেয় খাবার বানিয়েছিল , তার জন্য তাদের অবর্তমানে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। ভবিষ্যতে একদিন ওদের হাওড়ার বাড়িতে গিয়ে ওদের ধন্যবাদ দেবার ইচ্ছে আছে।
বর্ধমান স্টেশনে যখন নামলাম তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা। একটা অটো নিয়ে চারজন চলে এলাম ওর বাড়ীর কাছাকাছি ছোটো একটা সুন্দরী বৌদির চায়ের দোকানে,যে চায়ের স্বাদ আজ ও আমার মুখে লেগে আছে। উঠে চলে এলাম মান্নার দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়ি বললে ভুল বলা হবে; ছোট খাঁটো একটা রাজপ্রাসাদ বলা যায়। আর সেই রাজপ্রাসাদে সাধারণ
মানুষের প্রবেশাধিকার যে সহজে হয় না,তা কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম। বিরাট কোলাপসিপল গেট,তারপর দরজা,তারপর আবার গেট; তারপর আবার দরজা; আবার ঘরে ঢোকার দরজা। মোট দশখানা তালাচাবি। ঢোকার মুখেই বড়ো ধাক্কা। রাজবাড়ীতে অত সহজে ঢোকা যায় নাকি?
মান্না কিছুতেই চাবি খুলতে পারলো না। আধা ঘন্টা চেষ্টার পর মান্না কোলকাতায় ফোন লাগালো। ইতিমধ্যেই চাবি হাত নিলাম আমি ; বর্ধমান আমাকে ঠিক চিনতে পেরেছে।অতি সহজেই খুলে গেল চাবি।
ঘরের ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম ; দুখানা পেল্লাই সাইজের শোবার ঘর। সামনে লম্বা বারান্দা, পাশে কিচেন, দুখানা বাথরুম। Fresh হয়ে চারজন বেরিয়ে পড়লাম কোর্ট চত্বরে; ওখানে মান্নার বহু দিনের পরিচিত হোটেল এ হোটেল মালিক, জামাই আদর করে আমাদের বসালো। পাতে পড়লো,ডাল,বেগুনি, দই কাতলা, পোস্তবড়া,পাপড়,চাটনি, মিষ্টি। দুপুরে এতটা ভুরিভোজ হয়েছে যে, বিছানায় দেহ না রাখা পর্যন্ত স্বস্তি মিলেনি।
আমাদের জন্য অটোর ব্যবস্থা করাই ছিল; বেলা তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম বর্ধমান শহর ঘুরতে।
বর্ধমান পশ্চিমবঙ্গের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি সুন্দর শহর।
এটি তার ধান ক্ষেত, “সীতাভোগ বা মিহিদানা” এর মতো মিষ্টান্ন এবং বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিচিত।
এছাড়াও বর্ধমানে প্রচুর আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে যা ঘুরে দেখতে আমরা চারজন বরিষ্ঠ নাগরিক আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলাম।
বর্ধমান শহরের নবাবহাটের ১০৮ শিব মন্দির কমপ্লেক্স একটি উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থান যা সারা বিশ্বের মানুষকে আকর্ষণ করে।
বলে রাখা ভালো যে বর্ধমানে এরকম দুটি ১০৮টি শিব মন্দির কমপ্লেক্স রয়েছে, একটি নবাবহাটে এবং অন্যটি কালনায়।
নবাবহাট অঞ্চলে অবস্থিত মন্দিরগুলো একটি আয়তাকার আকৃতি করে রয়েছে। কালনা কমপ্লেক্সে একটি কেন্দ্রীভূত প্যাটার্নে ১০৮টি শিবমন্দির গুলি রয়েছে।
নবাবহাট কমপ্লেক্সে একটি প্যাভিলিয়ন এবং কয়েকটি সুন্দর ভবনও রয়েছে।
শ্রী বিজয় চাঁদ মহাতাবের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে, বর্ধমানের মহারাজা ১৯০৩ সালে জিটি রোড এবং বিসি রোডের সংযোগস্থলে এই বিশাল তোরণটি তৈরি করেছিলেন। ১৯০৪ সালে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সফরের সময় তোরণটি “কার্জন গেট” নামকরণ হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী যুগে, এর নামকরণ করা হয়েছিল “বিজয় তোরণ”। সুব্রত মান্না অত্যন্ত ভাগ্যবান, কেননা ওর পৈতৃক বাড়ি ঠিক এই তোরণের কাছাকাছি।
এ ছাড়াও আমরা ঘুরলাম সর্বমঙ্গলা মন্দির।
১৭০২ সালে মহারাজা কীর্তিচাঁদ দ্বারা সর্বমঙ্গলা মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল, যেটি বর্ধমানের ডিএন সরকার রোডে অবস্থিত। মাতা সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি প্রায় ১০০০ বছর পুরনো। এটি অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন মন্দির।
অটোওয়ালার বদান্যতায় আমরা রেল লাইন ছাড়িয়ে চলে এলাম কাঞ্চন নগরে।
কঙ্কালেশ্বরী মন্দিরটি বর্ধমান শহরের কাঞ্চন নগরে অবস্থিত। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে দামোদরের পাশের নদীতে মন্দিরের কালী প্রতিমাটি পাওয়া গিয়েছিল। মন্দিরে নয়টি শৃঙ্গ রয়েছে যার ফলে “নবরত্ন মন্দির” নামে পরিচিত। এটি পূর্ব বর্ধমানের দ্বিতীয় নবরত্ন মন্দির।
এর পর আমরা দেখতে এলাম খাজা আনোয়ার বেড়।
খাজা আনোয়ার বেড় নবাব বাড়ি বর্ধমানের দক্ষিণ অংশের দিকে অবস্থিত এবং প্রায় তিনশত বছরের পুরানো। এই নির্মাণটি চারদিকে উঁচু দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত এবং এই ভবনের স্থাপত্য শৈলীটি ইন্দো-সিরিয়ান স্থাপত্যের নিখুঁত মিশ্রণ। বিল্ডিংয়ের ভিতরে একটি উইন্ড-হলের বা হাওয়াঘর এর মাঝখানে একটি গভীর পুকুর রয়েছে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে
বর্ধমানের গোলাপব্যাগ বা গোলাপের বাগান, একটি প্রিয় পর্যটন স্থান। এটি ১৮৮৩ সালে রাজা বিজয় চাঁদ মাহাতাব প্রতিষ্ঠিত বোটানিকাল এবং প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কিত উদ্যান। বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী ডালটন হুকার এখানে এসে ১২৮ ধরণের গাছ তালিকাভুক্ত করেছেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কমপ্লেক্সে ক্লাসও নেয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা পারমিশন পেয়ে ও অনেক খানি হেঁটে যাওয়ার ভয়ে গোলাপ বাগ আমরা দেখতে পেলাম না। অটো চলাচল ওখানে নিষিদ্ধ ছিল।
বর্ধমানের দৈত্যাকার চার-লেনের কেবল-স্থিত রেলওয়ে ওভার ব্রিজটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৮৮.৪৩ মিটার কেবল স্থিত রবটির লেনের সমান্তরাল প্রতিটি পক্ষের ১.৫ মিটার-প্রশস্ত ফুটপাথ রয়েছে চার লেনে যান চলাচলের জন্য আরওবিটির প্রস্থের ২৭.৭ মিটার রয়েছে। সেতুটি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে উদ্বোধন করা হয়েছিল।
পরের দিন সকাল আটটার বর্ধমান লোকাল ধরে ফেরার আগে অন্তরে কেমন যেন একবেদনা অনুভূত হলো। ছেড়ে চলে যাওয়ার বেদনা। বর্ধমান শহরটাই আমার কাছে মায়ের মতো মনে হল। মাকে ছেড়ে যেতে সন্তানের যেমন বেদনা অনুভূতি হয়, তেমনি আমার ও মনে বিযোগ ব্যাথা অনুভূত হলো। চোখে জল এলো। চশমা ঝাপসা হয়ে উঠলো। মনে হলো আর একবার নেমে গিয়ে মাতৃমন্দির দর্শন করি। মনে হলো মান্নার সেই নিচের ঘরটাতে আর একটা রাত কাটিয়ে আসি । মা সর্বমঙ্গলার কাছে আর একটা দিন কাটাই। পা দুটো ট্রেন থেকে নেমে আসার সংকেত দিচ্ছে। একবার মনে হলো নেমে যাই। কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।
""''কলমে -নিতাই""'"""