28/04/2021
জায়গার নাম 'তুঙ্গাসি টপ', বা হতে পারে 'তুঙ্গাশ্রী টপ'।
উচ্চতা প্রায় 11000 ফুট বা 3100 মিটার।
কার্যত এটা একটা পাহাড়ের মাথা, যার একদিকে জাঞ্জেলি ভ্যালি, অন্যদিকে হিমাচলের চরম আইসলেটেড একটা ভ্যালি 'গাড়াগুসৈনি'।
জাঞ্জেলি থেকে 12 কিমি দূরত্বের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিনহাজার ফুটের চড়াই ভেঙে এখানে এসে পৌঁছেছি আমার সাইকেল ও জিনিসপত্রসহ প্রায় 30 থেকে 35 কেজির ওজন ঠেলে। তবে এই পথকে রাস্তা বললে রাস্তার অপমান হবে, বরং বলা ভালো নির্মিয়মাণ এক আধা রাস্তা আধা ধ্বংসস্তুপসম পাথর-জল-কাদা বরফের মিক্সড চানাচুর। অনেক ভেবেচিন্তেই তুলনামূলক সহজ ও কম চড়াই এর দ্বিগুন দূরত্বের অন্য যে পরিচিত কাঁচা রাস্তা আছে তা ছেড়েই এই রাস্তা নিয়েছি নতুন রাস্তা দেখবো বলে ও গুগল ম্যাপের আওতার বাইরের রাস্তা দিয়ে গাড়াগুসৈনি পৌছাবো বলে। রাস্তা কঠিন হবে জানতাম, পথে যার সাথেই কথা হয়েছে, গ্রামবাসী বলেছে এই রাস্তায় সাইকেল চড়বে না, আমি যেন না যাই, জঙ্গলে ফেঁসে যাবো, এদেরকে আমাকে অনুমতিপত্র রূপে শুধু বলতে হয়েছে, আগের দিন আমি শিকারি দেবী চড়িয়েছি এই সাইকেল, ব্যাস তার পরেই... 'তো ফির আপ তো ইয়ে চড়া লেঙ্গে, যাও আপ' !
শুরু করার সময় তৈরিই ছিলাম যে আজ এই চড়াই শেষ হবে না, মাঝপথে কোথাও থেকে যাবো। খোঁজ খবর নেওয়া আছে, মাঝপথে 'রেশন' এই পথের শেষ গ্রাম, (বুঝতে অনেকটা সময় গেছে যে এটা কোনো রেশনের দোকান নয়, একটি গ্রামের নাম) যেখানে আমি ক্যাম্প করতে পারবো। পথের শুরু থেকেই রাস্তা আমার ফুসফুস, শক্তি আর ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল। শম্বুক গতিতে খাড়া কাঁচা রাস্তার চড়াই বেয়ে গলদঘর্ম হয়ে 'কুদওয়ার' পেরিয়ে যখন 'রেশন' পৌছালাম, তখনও অনেকটা সময় আছে অন্ধকার হতে, এখানে দিনের আলো থাকে সন্ধে সাতটা অবধি। এত তাড়াতাড়ি থামতে ইচ্ছা করছে না, এদিকে এক এক জন মানুষ এক এক রকম আশাবাদী বার্তা দিচ্ছে সামনে রাস্তা সম্পর্কে। সব শুনে মনে হল আমার কাছে যথেষ্ট সময় আছে অন্ধকার হওয়ার আগে চূড়ায় বা 'চটি'তে পৌঁছনোর, যেখানে দুটি দোকান অর্থাৎ মানুষের চিহ্ন আছে এর পরে, যেখানে আমি রাত কাটিয়ে দিতে পারব। কিন্তু রেশন ছেড়ে বেরোতেই শুরু হল বিপর্যয়। প্রায় দুই তিন কিমি জুড়ে আলগা পাথর, নুড়ি, স্লেট পাথরের টুকরো ছড়ানো এই রাস্তার সবথেকে বেশি চড়াই ওয়ালা প্যাচটুকু, যেখানে সাইকেল ঠেলে তোলাও একরকম কার্যত অসম্ভব। কোনোক্রমে সেই রাস্তাটুকু পেরোলাম এই ভরসায় যে একজন বলেছে এই টুকুই সব থেকে খারাপ অংশ এই রাস্তার, এরপর অপেক্ষাকৃত সাইকেল চালানোর মত রাস্তা পাওয়া যাবে। কিন্তু ও হরি কোথায় কি, এরপর শুরু হল গুঁড়ো মাটির একের পর এক খাড়া চড়াই যা আর শেষই হয় না। এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত , অন্ধকার হওয়ার আগে মানুষের চিহ্নের কাছে পৌঁছাতেই হবে, এই এলাকায় বন্য জীবজন্তুর ভয় প্রবল, একা জঙ্গলে বরফের মাঝে রাত্রিযাপন সম্ভব না। কোনো প্রকারে গুঁড়ো মাটির চড়াই শেষ করে, যখন একটুকরো সমতল রাস্তায় পৌঁছেছি, যার দুই দিকে খাদ, দেখে মনে হচ্ছে একটা রিজের ওপরে পৌঁছেছি, এর পরে আর কোনো চড়াই থাকার কথা নয়, এমন সময় সামনে থেকে আসা এক দল শিকারির সাথে দেখা। তারা বললো এখনো প্রায় 4 কিমি বাকি, বেশ কয়েকটি চড়াই তার মধ্যে, তারপর কিছুটা সমতল রাস্তা, আলো পড়ার আগে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। আকণ্ঠ উদ্বেগ নিয়ে অন্ধকার প্রায় হয় হয় এমন সময় বাকি চড়াই টুকু শেষ হলো। মনে ভাবলাম এবার হয়তো শান্তি, খুব অল্প সময়েই বাকি দু কিমি সমতল রাস্তা চালিয়ে নিতে পারবো। এমন সময় দেখা আর এক বন্দুকধারী শিকারির সাথে, সে জানালো 'চটি' অবধি পৌঁছাতে এখনো বাকি দুই কিমি পথ, যা আসলে রাস্তার নামে বরফ গলা কাদা জল, মাটি আর বরফের প্যাচপ্যাচে নরককুন্ড যার ওপর দিয়ে সাইকেল চালানো অসম্ভব। এদিকে অন্ধকারও নেমে আসছে, এখান থেকে নিচের দিকেও ফেরত যাওয়ার পথ আর নেই, যেমন করেই হোক পৌঁছাতেই হবে। দুদিনের অমানুষিক চড়াই ঠেলার খাটনি, নীচে থেকে কয়েকহাজার ফুট চড়াই ঠেলে আসা ক্লান্ত হাত পা সব ভুলে একটুও সময় নষ্ট না করে শরীরের শেষ বিন্দু টুকু প্রয়োগ করে দিলাম রাস্তার ওপর। আনুমানিক কয়েকশো মিটার এগোতেই বরফ বাড়তে থাকলো, এবার চারপাশ সাদায় সাদা, পায়ের নিচে প্যাচপ্যাচে গভীর বরফ ওয়ালা কাদা জল, এদিকে দিনের আলো প্রায় তার শেষ নিভু নিভু অবস্থায়। এমন অবস্থা থেকে এক মুহূর্তও না থেমে, ছবি ভিডিওর লোভ সম্বরণ করে, প্রায় একটানা কাদা বরফ ঠেলে ওই রাস্তাটুকু পার করে যখন পাহাড় চূড়ার সেই বহু আকাঙ্খিত দোকানটি, যা আসলে কাঠের খুঁটিতে বাধা পলিথিনের একটি আস্তরণ, চোখে পড়ছে, আমার বিপন্ন বিস্ময় ভেঙে গেল দোকানদারের দুই বিশালাকৃতি কুকুরের গর্জনে, বুঝে গেলাম, যাক, এযাত্রা প্রাণ বাঁচিয়ে নিয়েছি আমার আজকের মত।
আমি ঠান্ডায় ক্লান্তিতে অর্ধমৃতপ্রায়, দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই, হাতে ফোস্কা পরে গেছে ক্রমাগত সাইকেল ঠেলে ঠেলে, ঘাড় একদিকে ঘোরাতে পারছি না, এমন অবস্থায় কোনো প্রকারে সাইকেলটা বরফের ওপরে রেখে পলিথিনের সিটের আবরণের তলায় ঢুকতেই এগিয়ে এলো উষ্ণ অভ্যর্থনা, গরম কফি, সঙ্গে আগুন। হায় ঈশ্বর কি পুণ্য করেছিলাম জীবনে এমন সৌভাগ্যবান হওয়ার মতো!
আমি যতক্ষণে এখানে এসে পৌঁছেছি, এদের থাকার কথা নয়। দোকান বন্ধ করে চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু পথে যে দুই শিকারির সাথে দেখা হয়েছিল, তাদের কেউ একজন এদেরকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, 'এক বান্দা যা রাহা হ্যায় উপার, দেখ লেনা'। সেই ফোনের জোরেই এনারা সময় গড়িয়ে যাওয়ার পরেও একটু অপেক্ষা করে গেলেন আমার জন্য।
এই রাত দিন সম্পর্কে যেটুকু রোমাঞ্চ, বিপর্যয়ের অংশ তা এখানেই শেষ । এর পরের টুকু তুলনামূলক মনোরম, এক অদ্ভুত নৈসর্গিক, নিজ সৌভাগ্যের প্রতি শ্রদ্ধায় আনত এক মায়াবী রাত। এই স্থান থেকে দুই হাত খুলে যতটুকু আকাশ ধরা যায় অর্থাৎ একশো আসি ডিগ্রি জুড়ে চোখের সামনে খোলা অপেক্ষাকৃত বরফ ঢাকা শৃঙ্গ মালা, রোটাং থেকে কিন্নর অবধি। সন্ধে অন্ধকারে গড়াতেই সেই শৃঙ্গ মালার পিছন থেকে বেরিয়ে এলো পরিষ্কার আকাশে পূর্ণিমার আগের রাতের চাঁদ। এই জনমানবহীন পাহাড় চূড়ায় আমরা দুটি মানবশিশু, আমি ও দোকান মালিকের রেখে যাওয়া তার ভাগ্নে যে রাতে আমার সাথে থাকবে, সেই মায়াবী আলোয় ভেসে যাওয়া বরফ ঢাকা পাহাড় চূড়ার সাক্ষী হয়ে রইলাম। তিনিই রাঁধলেন টর্চ জ্বালিয়ে রাতের খাবার। ধোঁয়া ভরা পলিথিনের কুটিরের মধ্যে আমরা ঘুমালাম দুটি সারমেয়র অতন্দ্র প্রহরায়।