04/08/2024
#বন্যা__২০০০ #নবদ্বীপ #ফিরে_দেখা
১৭ই সেপ্টেম্বর ২০০০। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দুপুর গড়াতেই শুরু হল বৃষ্টি। যারা ঘুড়ি ওড়াবে ভেবেছিল তাদের ইচ্ছে , সুতো, ঘুড়ি, লাটাই --সব পড়ে রইলো ঘরের কোণে। বৃষ্টি চলেছিল টানা সাতদিন , সারাদিন, সারারাত। বেগ কখনও বেড়েছে কখনও কমেছে কিন্তু থামেনি এক মুহূর্তের জন্যও।
মিনি বন্যায় অভ্যস্ত প্রান্তিক নবদ্বীপে সে বছর বন্যার কোন পূর্বলক্ষণ ছিল না । খুশীর গোঁফে তা দিতে দিতে মানুষজন ভেবেছিল এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম বুঝি! মেঘ নিশ্চয়ই তখন মুচকি হেসেছিল।
আমার তখন হাফপ্যান্ট বয়স। প্যাক কোম্পানির মাঠের পাশে থাকি। বিছানা ভিজে যাওয়ায় এক ভোরে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল। না, না কোন 'দুষ্কর্ম' করিনি! চোখ মেলে দেখি বন্যার জল চৌকির সব পায়া খেয়ে পাটাতন ছুঁতে চলেছে। বিছানা ও পিঠে তারই সিক্ত পরশ! হাড়ির ভিতর প্লাবন, পান্তাভাত ভেসে যায় ভাগীরথীর জলে।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি বিপুল কালো জলরাশি পাড়া-মাঠ-ঘরবাড়ি ভাসিয়ে গঙ্গামুখো চলেছে। এতদিন এর উল্টোটাই হত। পূব থেকে পশ্চিমমুখী গঙ্গা উপচানো জল ভাসিয়ে দিত জনপদ।
অবশেষে কালো জলের গঙ্গাপ্রাপ্তির পর অজয়ের রক্তাভ ধারাস্রোত দখল নিল শহরের। ঘন শ্যামবর্ণা ছাড়াগঙ্গা তখন নতুন সাজে।
নিখাকি ঘরের সামান্য বোঁচকাবুচকি নিয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে উঠলাম রাণীরঘাটের রাধারাণীর মন্দিরে। ততক্ষণে সেখানে বন্যার্ত মানুষের থিকথিকে ভিড়। 'শৌচাগার' তখন পৃথিবীর সবচেয়ে হাস্যকর শব্দ। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে মানুষ অসহায় বাধ্যতায় প্রকাশ্য দিবালোকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। চারিদিকে থইথই ইউরিন।
বাড়তে বাড়তে জল উঠে গেল রাধারাণীর পেল্লাই নাটমন্দিরেও। আবার ছুটোছুটি। নাটমন্দিরের উপরে দোতলা উচ্চতায় বিরাট বিরাট সিমেন্টের 'বাঙ্কে' উঠে গেল অধিকাংশ পরিবার। আমরা ঠাঁই নিলাম বিগ্রহের ঠিক পাশটাতে। যে সরু চতুর্ভূজ পথে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে প্রণাম সেরে ভক্তবৃন্দ পরিক্রমা করে সেই পথের মাঝে। আমাদের পাশেই আস্তানা নিয়েছে হ্যাবলাদা। সকলের দাদা কাঠমিস্ত্রী এই মানুষটি স্বল্প জ্বালানী কাঠ চিরে ছোট ছোট টুকরো করে মাটির উনুনে রান্না করে। ফুল-চন্দন-ধূপের সাথে মিশে যায় ভাত ফোটার গন্ধ। পেটের ভিতরটা কেমন চিঁচিঁ করে ওঠে।
প্রবীণ যাদের মুখে ১৯৭৮ --এর ভয়াবহ বন্যার গল্প শুনেছি তারাও হতবাক। দিনমানে নৌকা বয় শহরের প্রশস্ত রাস্তায়। নবদ্বীপ তখন একটি নদীর নাম। রাজপথে সাঁতার কাটে কচিকাঁচারা। চারিচড়া বাজারে দাঁড়িয়ে জাবরকাটা ভিন পাড়ার গরুরা বাড়ি ফেরার আশায় দিন গোনে।
সন্ধ্যায় রাধারাণীর মন্দিরে সন্ধ্যারতি শেষে বাবা হারমোনিয়াম বাজিয়ে ভজন ধরে --'প্রভু মোর দিন বয়ে যায় দরশন বিনা।' করতালে তাকে সঙ্গত করে কাজহারানো ছেঁড়াজামা রিকশাওয়ালা। বিদ্যুৎহীন রাতে বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। মোমবাতি, হ্যারিকেন, ডিমলাইট --হরেক রকম, হরেক রঙ তার। আকাশবাণী কলকাতা--ক '-এ শঙ্কর মুখোপাধ্যায় খবর পড়েন রাত দশটা পাঁচে।
তেমনই এক রাতভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁর অনন্য স্বরক্ষেপণে বলে উঠলেন --'আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা...। ' চরাচর জলমগ্ন শহরে ও সময়ে যখন ভেসে গেছে সংসার , সব ও শব --তখন 'আনন্দময়ী'-র আগমন বার্তা কেমন উদাস, বিবশ করে দিচ্ছিল ভিতরটা।
জল একটু নামতেই কিছু কিছু অঞ্চলে বিদ্যুৎ ফিরে এল। চলছে আইসিসি নকআউট ট্রফি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা ২০০০। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলিয়ে সব দেশ অংশগ্রহণ করেছে তাতে। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে কেনিয়ায়। ভারতীয় সময় বেলা তিনটেয় খেলা শুরু।
যা জুটল -ফুটল --তা-ই খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম আমরা ছেলেপিলেরা। রাণীরঘাট বেয়ে, বড়ালঘাট হয়ে, বড় বাজারের মধ্যে দিয়ে চলেছি। কোথাও কোমর জল, কোথাও হাঁটু। বড় বাজারের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় নাক চেপে যেতে হয়। জলের নিচে টন টন ডাল, চাল, বিস্কুট সহ নানা দ্রব্য। পচে গিয়ে তা বিচিত্রগন্ধী, পা আটকে যায় স্তূপীকৃত ঐ নষ্ট খাদ্যদ্রব্যে। ভাসছে সয়াবিনের মরা প্যাকেট, বিস্কুট কোম্পানির নাম। দেবেন সাহার গলি দিয়ে যাওয়া আরও মুশকিল। বদ্ধ জল জমে বদগন্ধী ও কালো হয়ে গেছে।
ঢপওয়ালীর মোড়ে মডার্ন মাইকের দোকানে টিভি চলছে। ব্যাট-বল হাতে যুবরাজ সিংহ --জাহির খানদের অভিষেকেই বাজিমাত। অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাকগ্রাকে সচিনের বেধড়ক পিটুনি। একের পর এক দেশকে হারিয়ে ভারত ফাইনালে। প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।
উডবার্ন রোডে আর জল নেই। খুলে গেছে তরুণ সঙ্ঘ ক্লাব। ওখানেই হচ্ছে থুড়ি দেখছি --ফাইনাল ম্যাচ। কিন্তু হায়! ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশায় জল ঢেলে দিল নিউজিল্যান্ডের অলরাউন্ডার ক্রিস ক্রেয়ার্নস! আহত পা নিয়েই ব্যাটিং তাণ্ডব চালিয়ে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের শিরোপা ছিনিয়ে নিল তারা।
সব হারিয়ে এবার ফেরার পালা। জল নেমে গেছে ততদিনে। বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে আমরাও ফিরে এলাম। প্যাকের মাঠের পাশটিতে , রাস্তার ধারে। সাড়ে চার বাই তিন হাত ফুটপাথে ; যেখানে আমরা /আমাদের পরিবার থাকত । মাথার উপরে ত্রিপল, তিনপাশে ক্ষয়িষ্ণু বেড়া, আর একপাশে অমরনাথের পাওয়ারলুমের পাঁচিল। একটা চৌকি, একটা ছোট্ট টেবিল। পাঁচিলের গায়ে ফাঁক-ফোকর, নকশাকাটা। তার সাথেই প্রচণ্ড দড়ি দিয়ে চৌকি ও টেবিল বেঁধে দিয়েছিল বাবা, রাধারাণীর মন্দিরে যাওয়ার আগে, যাতে ভেসে না যায়! এসে দেখলাম তার কিছুই নেই! ভেসে গেছে সব। ভেসে গেছে ক্লাস ফোর থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত আমার শৈশবস্মৃতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলার মত বয়সী গভীরতা তখন ছিল না। শুধু দেখলাম মাথার উপরে নীল-সাদা আকাশে সোনারোদ।
কলমে 🖋️ বিশ্বরূপ সাহা Biswa Rup
(ছবি ২০০০ সালের নবদ্বীপের বন্যা)
তথ্য সংগ্রহনে - Nabadwip.Royal Society - poramatala mahishasurmardini
ধন্যবাদ ❤️
#নবদ্বীপধাম #নবদ্বীপেরবন্যা #বন্যা