13/01/2023
মেঘালয় ভ্রমণের আদ্যোপান্ত
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশী ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ভারতের যে কয়টি রাজ্য ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয় তার মধ্যে মেঘালয় অন্যতম। আমরা যারা তামাবিল, জাফলং ভ্রমণ করেছি এবং নিজের অজান্তে চোখ উঁচু করে যে পাহাড় গুলো দেখেছি আর মনে মনে সেখানে যাবার ইচ্ছে পোষণ করেছি তা হল মেঘালয়ের অন্যতম শহর ডাওকি। এই ডাওকি ছাড়াও ভ্রমনপিপাসুদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় দুইটি শহর হল শিলং এবং চেরাপুঞ্জি। শিলং হল মেঘালয়ের রাজধানী। অপরূপ সৌন্দর্যে পরিবেষ্টিত এই শহরটি “প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড” নামেও পরিচিত। এছাড়াও চেরাপুঞ্জি শহরটি ভ্রামণপিপাসুদের কাছে থাকে অন্যতম মূল আকর্ষণ, যার নাম আমি দিয়েছি “দ্যা সিটি অফ ওয়টারফল”। মেঘে ঘেরা এই শহরটি না ঘুরে এলে ভ্রমণের অপূর্ণতা থেকেই যাবে।
কখন মেঘালয় ভ্রমনে যাবেন?
সময় নির্বাচন ভ্রমণের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মেঘালয় অসীম সৌন্দর্য সারা বছরই উপভোগ করা যায়। সাধারণ ভাবে মেঘালয়ের আবহাওয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে – গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীত। মূলত এপ্রিল থেকে জুন মাসকে ধরা হয় গ্রীষ্মকাল, এসময় মেঘালয়ের তাপমাত্রা ১৫-২৮ ডিগ্রি সেঃ এর মধ্যেই থাকে। এসময় ঝর্ণাগুলো মোটামুটি সক্রিয় থাকে, ঝর্ণাতে পানির প্রবাহ থাকে বেশ ভাল। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বার মাসকে বলা হয় বর্ষাকাল। এসময় মেঘালয়ের তাপমাত্রা কিছুটা কমে ১৫-২০ ডিগ্রি সেঃ এর মধ্যে নেমে আসে। যেসকল ভ্রমনপিপাসু ঝর্ণার ভয়ংকার রূপ দেখতে ভালবাসেন তাদের জন্য এই সময়টা বেশ উপযুক্ত। যারা বর্ষাকালে মেঘালয় ভ্রমণে যেতে চান তাদের জন্য বেশ কিছু তথ্য দিয়ে রাখি, এসময় মেঘালয়ে ভারি থেকে উচ্চতর ভারি বর্ষণ হয়ে থাকে। চারিদিক থাকে মেঘে ঢাকা, যেকারণে ঝর্ণা গুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে আপনাকে বেশ বেগ পেতে হবে এমনকি আপনাকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতেও হতে পারে। যেকারণে অনেক ভ্রমনপিপাসুর কাছে এই সময়টা মেঘালয় ভ্রমণের জন্য প্রিয় সময় নয়। অক্টোবর থেকে মার্চ মাসকে বলা হয় শীতকাল। এসময় মেঘালয়ের তাপমাত্রা ০৪-১৬ ডিগ্রি সেঃ এ নেমে আসে। এসময় ঝর্ণায় পানির প্রবাহ বেশ কমে আসে তবে পানি থাকে খুব পরিস্কার। পরিশেষে বলা যায় অক্টবার থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মেঘালয় ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
ভ্রমণের পূর্ব প্রস্তুতিঃ যে সকল ভ্রমণপিপাসু মেঘালয় যাবেন বলে মনস্থির করেছেন তাদেরকে আমি তিন ভাগে ভাগ করেছিঃ-
১। পাসপোর্ট এবং ভিসা কোনটিই নেই।
২। পাসপোর্ট আছে কিন্তু ভিসা নেই।
৩। পাসপোর্ট এবং ভিসা দুইটিই আছে কিন্তু ডাওকি বর্ডার সংযুক্ত নেই।
১। পাসপোর্ট এবং ভিসা কোনটিই নেইঃ
আপনারা যারা মেঘালয় যেতে চান কিন্তু পাসপোর্ট নেই তাদেরকে অবশ্যই দেড় থেকে দুই মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। একটি বিষয় জেনে রাখা ভাল যে, আপনারা যারা সাধারণ ক্যাটাগরিতে পাসপোর্ট করাতে চান তাদের সময় লাগবে ২১ থেকে ৩০ দিন আর যারা জরুরী ভিত্তিতে পাসপোর্ট করতে চান তাদের সময় প্রয়োজন ৭ থেকে ১০ দিন। পাসপোর্ট হাতে পেয়ে গেলে দ্রুত ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। ভিসার আবেদন পত্র জমা দেয়ার পর থেকে ৭ দিন সময় লাগে ভিসা পেতে। ভিসা ফি ৮০০ টাকা। মনে রাখবেন ভিসা আবেদন পত্রে অবশ্যই ডাওকি বর্ডার দিতে হবে।
সাধারণ এবং জরুরী ভিত্তিতে পাসপোর্ট করতে কি পরিমাণ ফি দিতে হয় তা নিম্নে দেয়া হলঃ
পাসপোর্টঃ ৪৮ পৃষ্ঠা এবং ৫ বছর মেয়াদ
সাধারণ ফি (২১ দিন): ৪০২৫ টাকা
জরুরি ফি (১০ দিন): ৬৩২৫ টাকা
অতি জরুরি ফি (২ দিন): ৮৬২৫ টাকা
পাসপোর্টঃ ৪৮ পৃষ্ঠা এবং ১০ বছর মেয়াদ
সাধারণ ফি (২১ দিন): ৫৭৫০ টাকা
জরুরি ফি (১০ দিন): ৮০৫০ টাকা
অতি জরুরি ফি (২ দিন): ১০৩৫০ টাকা
পাসপোর্টঃ ৬৪ পৃষ্ঠা এবং ৫ বছর মেয়াদ
সাধারণ ফি (২১ দিন): ৬৩২৫ টাকা
জরুরি ফি (১০ দিন): ৮৬২৫ টাকা
অতি জরুরি ফি (২ দিন): ১২০৭৫ টাকা
পাসপোর্টঃ ৬৪ পৃষ্ঠা এবং ১০ বছর মেয়াদ
সাধারণ ফি (২১ দিন): ৮০৫০ টাকা
জরুরি ফি (১০ দিন): ১০৩৫০ টাকা
অতি জরুরি ফি (২ দিন): ১৩৮০০ টাকা
২। পাসপোর্ট আছে কিন্তু ভিসা নেইঃ
যেসকল ব্যক্তির ইতিমধ্যে পাসপোর্ট করা আছে তাদের উদ্দেশ্য বলছি আপনাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই কারণ আপনারা ১৫ থেকে ২০ দিন আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু করলে খুব সহজে মেঘালয় ভ্রমণের সকল প্রস্তুতি সারতে পারবেন। তবে একটি কথা অবশ্যই মাথায় রাখা জরুরী তা হল ভিসা নিতে হলে আপনার পাসপোর্টের মেয়াদ সর্বনিম্ন ৬ মাস থাকতে হবে। তাই এখুনি আপনার পাসপোর্টের মেয়াদটি যাচাই করে নিন। যদি মেয়াদ ৬ মাসের বেশি থাকে তবে দেরি না করে ভিসার জন্য আবেদন করে ফেলুন, আর যদি মেয়াদ ৬ মাসের কম থাকে তবে দ্রুত আপনার পাসপোর্ট টি রি-ইস্যু জন্য আবেদন করুন।
৩। পাসপোর্ট এবং ভিসা দুইটিই আছে কিন্তু ডাওকি বর্ডার সংযুক্ত নেইঃ
যেসকল ব্যাক্তির ইতিমধ্যে পাসপোর্ট এবং ভারতের ভিসা উভয় করা আছে কিন্তু ডাওকি বর্ডার সংযুক্ত করা নাই তারা খুব সহজে ৩০০ টাকা ফি প্রদানের মাধ্যমে ডাওকি বর্ডারটি সংযুক্ত করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রেও সময় প্রয়োজন ৬ থেকে ৭ দিন।
ভ্রমণ করঃ
আপনি যদি যেকোন স্থলবন্দর দিয়ে ভারত ভ্রমণে যেতে চান তবে আপনাকে ৫০০ টাকা ভ্রমন কর বা ইংরেজিতে বলা হয় ট্র্যাভেল ট্যাক্স দিতে হবে। এই কর আপনি সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় খুব সহজে দিয়ে দিতে পারবেন। এই কর আপনাকে অবশ্যই ভারত ভ্রমণের পূর্বেই দিতে হবে।
টাকা না ডলার নিবেন?
একজন ভ্রমণকারী বৈধ ভাবে নগদ সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫,০০০ ডলার তার সঙ্গে নিতে পারবেন। তবে আপনি যে পরিমান ডলার সঙ্গে নিবেন তা আপনার পাসপোর্টে এন্ডো্রসমেন্ট করিয়ে নিতে হবে। আপনি ব্যাংক অথবে মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ক্রয় করতে পারবেন এবং সেখান থেকেই এন্ডোরসমেন্ট করাতে পারেন। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে এন্ডোরসমেন্ট করাতে ২০০ টাকা ফি দিতে হবে এবং ব্যাংক তার স্ব স্ব নিধারিত ফি গ্রহণ করবে।
টাকা বা ডলার কোথায় ভাঙাবেন?
যে সকল ব্যাক্তি টাকা নিয়ে যাবেন তারা অবশ্যই টাকা ডাওকি বাজারে ভাঙাবেন কারণ এখানে টাকার দাম ভাল পাওয়া যায়। আর ডলার ভাঙাবেন শিলং পুলিশ বাজারে। ডলার আপনি চাইলে ইস্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতেও ভাঙাতে পারেন সেক্ষেত্রে আপনার পাসপোর্টে অবশ্যই ডলার এন্ডোরসমেন্ট থাকতে হবে। একটি কথা স্মরণ রাখবেন শিলং পুলিশ বাজারে টাকার দাম একদমই ভাল পাওয়া যায় না।
সঙ্গে কি কি নিবেনঃ
আপনি যে সময়ই মেঘালয় ভ্রমণ করেন না কেন অবশ্যই সঙ্গে কিছু গরম কাপড় নিতে হবে। আপনি যদি বর্ষাকালে মেঘালয় বেড়াতে যান তবে অবশ্যই ভাল মানের একটি রেইন কোট সাথে নিতে হবে এবং অন্যান্য সময় ভ্রমণের জন্য ভাল মানের একটি ছাতা সঙ্গে রাখা অপরিহার্য।
কোন কোন বাস সিলেট যায়ঃ
শ্যামলী পরিবহণ (৪৭০ টাকা), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (৪৭০ টাকা), ইউনিক (৪৭০ টাকা), এনা ট্রান্সপোর্ট (৪৭০ টাকা), এনা ট্রান্সপোর্ট (এসি ১২০০ টাকা), গ্রীন লাইন পরিবহণ (এসি ১২০০ টাকা), লন্ডন এক্সপ্রেস (এসি ১০৫০-১২০০ টাকা)। এছাড়াও আরো কিছু বাস সার্ভিস রয়েছে।
কত জনের গ্রুপ হলে ভাল হয়?
মেঘালয়ে মূলত দুই আকারের গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। ছোট আকারের গাড়িতে সর্বচ্চো ধারণ ক্ষমতা ৪ জন এবং বড় আকারের গাড়িতে সর্বচ্চো ধারণ ক্ষমতা ৮ জন। আপনারা যারা একটু কম খরচে মেঘালয় ঘুরে আসতে চান তারা ৪ কিংবা ৮ জনের গ্রুপে যেতে পারেন। এতে করে প্রতি জনের গাড়ি ভাড়া কমে আসবে। এখানে বলে রাখি যে যদি কম খরচে ভ্রমণ করতে চান তবে দুইটি খরচ কমানোর চেষ্টা করবেন। প্রথমত গাড়ি ভাড়া, দ্বিতীয়ত হোটেল ভাড়া।
কোথায় থাকবেন?
আপনার যদি বিশেষ কোন পছন্দ না থাকে তবে শিলং পুলিশ বাজারের নিকটে থাকর চেষ্টা করবে। এতে করে আপনার ভ্রমণের আনন্দ কিছুটা হলেও বেড়ে যাবে। আমি এখানে বিশেষ পছন্দ বলতে বুঝিয়েছি ধরুন আপনার কোন বিশেষ রিসোর্ট কিংবা হোটেল আগে থেকেই পছন্দ করা আছে বা সেখানে যাবার ইচ্ছে রয়েছে, সেক্ষেত্রে আপানর বিশেষ ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়াই উত্তম। শিলং পুলিশ বাজারের কাছাকাছি বিভিন্ন মানের অনেক হোটেল রয়েছে। এসকল হোটেল চাইলে আপনি আগে থেকে বুকিং করে যেতে পারেন অথবা গিয়ে দেখে ঠিক করতে পারেন। তবে আগে বুকিং করে যাওয়ার কিছু সুবিধা এবং আসুবিধা দুইটি রয়েছে। আপনি ঠিক যে সময়টাই মেঘালয় ভ্রমনে যাবে সেসময় যদি পর্যটকের ভীষণ চাপ থাকে তবে আপনাকে হোটেল নিয়ে কোন চিন্তাই করতে হবে না যদি আপনি হোটেল আগে থেকে বুকিং করে যান। এছাড়াও পরিবার পরিজন কিংবা বন্ধু বান্ধব নিয়ে হোটেল খোঁজর ঝামেলা থেকেও বেঁচে যাবেন। তবে আগে থেকে হোটেল বুকিং করে গেলে হোটেলের প্রকৃত মান, দাম এবং অবস্থান সম্পর্কে একটি অস্পষ্ট ধারণা রয়েই যায়। অপরদিকে যারা মেঘালয় গিয়ে হোটেল বুকিং করতে চান তার ইচ্ছেমত ঘুরে হোটেল মান, দাম এবং অবস্থান যাচাই করে নিজের সাধ্যের মধ্যে হোটেল নিতে পারবেন। বিশেষ করে যারা একটু কম খরচে হোটেল থাকতে চান তাদের জন্য হোটেলর প্রকৃত অবস্থা দেখে হোটেল বুকিং করা জরুরী। কারণ কম দামের বেশিরভাগ হোটেলেই আমারা অপরিচ্ছন্নতা, গন্ধ, ছারপোকা ইত্যাদি লক্ষ করেছি। মেঘালয়ে মান ভেদে প্রতি জন সর্বনিম্ন ৩০০ রুপি থেকে সর্বচ্চো ৫০০০ রুপির মধ্যে থাকতে পারবেন।
কোথায় কোথায় কিভাবে ঘুরবেনঃ
সম্প্রতি আমরা ছয় বন্ধু মিলে ৪ রাত ৫ দিনের জন্য মেঘালয় ঘুরে এলাম। আমি এখন সেই ভ্রমণের সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করব। প্রথমেই বলে রাখি যে এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনাই আমি আপনাদেরকে মেঘালয় ভ্রমণের খরচ সম্পর্কে একটা ধারণা দিব। এছাড়াও কোথায় কোথায় যাবেন, কি দেখবেন, কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, কি খাবেন এই সম্পর্কিত কিছু কিছু তথ্য আপনারা এই বর্ণনাই পেয়ে যাবেন।
আমরা ৬ বন্ধু মিলে শ্যামলী পরিবহণ একটি বাসে করে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। আলহামদুল্লিহ খুব সকালেই আমরা আমাদের গন্তবে পোছে যায়। বাস থেকে নেমে সময় নষ্ট না করে লোকাল বাসে চেপে আমারা তামাবিলের উদ্দেশ্য যাত্রা করি। দুই ঘন্টা পর সকাল ৯ টার দিকে তামাবিল ইমিগ্রেশন পুলিশ চেক পোস্টে পোছে যায়। বাংলাদেশ অংশের ইমিগ্রেশনের কাজ করতে প্রায় আধাঘণ্টারও কম সময় লাগে। বাংলাদেশ অংশের কাজ শেষ করে ইন্ডিয়া বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ গেট পেরিয়ে আমরা ঢুকে পরি ভারতে। ভারতে ঢুকেই আমারা একটু হতাশ হয়ে যায় কারণ ভারতের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে আমাদের প্রায় আড়াই ঘন্টা মত সময় লেগে যায়। এত সময় লাগার মূল কারণ হল ভারতের ইমিগ্রেশন অফিসের সবকিছু এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চলে। যায়হোক ভারত অংশের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে আমারা সোজা চলে যায় ডাওকি বাজার। সেখান থেকে আমাদের সব টাকা রুপি করে নেই এবং ৪০০০ রুপি দিয়ে একটি ৮ সিটের টাটা সুমু গোল্ড গাড়ি ঠিক করি। গাড়িটি আমাদেরকে বেশ কিছু জায়গা ঘুরিয়ে সোজা শিলং পুলিশ বাজারে নামিয়ে দিবে। এখানে বলে রাখা ভাল যে আপনি চাইলে ইমিগ্রেশন অফিসের কাছ থেকেও গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন এতে করে আপনাকে ডাওকি বাজার পর্যন্ত হেটে যেতে হবে না।
প্রথম দিন আমরা যেসকল জায়গা ঘুরেছিঃ Umkrem falls, Boro Hill falls, Mowlynnong Village, Living Root Bridge। প্রথম দিনে গাড়ি ছিল ৮ সিটের টাটা সুমু গোল্ড এবং ভাড়া ছিল ৪০০০ রুপি। গন্তব্য ছিল ডাওকি বাজার থেকে ৪ টি জায়গা ঘুরিয়ে শিলং পুলিশ বাজার পর্যন্ত। রাত্রি যাপনঃ শিলং পুলিশ বাজার ।
ডাওকি বাজার থেকে আমাদের ভ্রমণের মূল পর্ব শুরু হয়। এখান থেকে প্রথমেই আমরা চলে যায় Umkrem Falls এ। ঝর্নাটি দেখতে বেশ সুন্দর তবে পানির প্রবাহ ছিল কিছুটা কম। অল্প কিছু সময় এখানে অতিবাহিত করে আমারা সোজা চলে যায় Boro Hill Falls এ। এই ঝর্নাটি সত্যি আমাদের মুগ্ধ করেছে। বেশ কিছুটা সময় এই ঝর্নাটি উপভোগ করে আমার এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম Mowlynnong এ চলে যায়। এই গ্রামে প্রবেশ করতে গাড়ি প্রতি ১০০ রুপি ফি দিতে হয়। ছবির মত সুন্দর গ্রামটি উপভোগ না করে যাবার কোন উপায়ই নেই। এখানেই আমারা আমাদের দুপুরের খাবারের পর্বটা সেরে নেই। জন প্রতি ১২০ রুপি করে নিলেও এখানকার খাবার আমাদের খুব একটা তৃপ্তি দিতে পারেনি। যায় হোক পেটে খিদা নিয়েই আমরা Living Root Bridge এর পথে রওনা দেই। এটি এই গ্রামের খুব কাছেই অবস্থিত। জন প্রতি ৪০ রুপি দিয়ে আমরা ঢুকে পরি এই জীবন্ত ব্রিজে। এই ব্রিজ এবং ব্রিজের চারপাশের সৌন্দর্য আমাদের খিদাকে কোথায় যেন উধাও করে দিল। ব্রিজের নিচে প্রবাহিত পরিষ্কার জলে কিছুক্ষণ পা ভিজিয়ে আমরা বেরিয়ে পরলাম শিলং এর উদ্দেশ্যে। শিলং যাবার রাস্তাটাও আপনাকে বেশ মুগ্ধ করবে। হাতে সময় থাকলে শিলং যাবার পথে বেশ কিছু ভিউ পয়েন্ট পাবেন সেগুলোতে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন। সন্ধ্যা হলেই শিলংএ সারি সারি গাড়ির লাইন বড় হতে থাকে। প্রচণ্ড জ্যাম ঠেলে রাত্রি ৮ টার দিকে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য শিলং পুলিশ বাজারে পৌছে যায়। গাড়ি থেকে নেমেই হোটেলের খোঁজে এই গলি থেকে ওই গলি ঘুরে ঘুরে অবশেষে দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা পর আমরা একটি হোটেল ঠিক করি। প্রতি রাত জন প্রতি ৪০০ রুপি খরচে ওই হোটেলে আমরা ৩ রাত থাকার জন্য উঠে পরি।
দ্বিতীয় দিন আমরা যেসকল জায়গা ঘুরেছিঃ Ward's Lake, Cathedral Church, Don Bosco Museum, Mawphlang। দ্বিতীয় দিনে গাড়ি ছিল ৮ সিটের টাটা সুমু গোল্ড এবং ভাড়া ছিল ২০০০ রুপি । চুক্তি ছিল Don Bosco Museum এবং Mawphlang এই দুইটি জায়গা ঘুরিয়ে নামিয়ে দিবে শিলং পুলিশ বাজারে। রাত্রি যাপনঃ শিলং পুলিশ বাজার।
প্রথম দিনের দীর্ঘ ভ্রমেণের ক্লান্তি কাটাতে দ্বিতীয় দিনটা আমরা একটু আরাম আয়েশ করে শিলং শহরের আসে পাশে ঘুরে কাটায়। সকালে শিলং সেন্টার পয়েন্টে অনেক গুলো খাবারের অস্থায়ী দোকান বসে, সেখান থেকেই ২০ রুপি দিয়ে সকালের নাস্তা করে চলে যায় মানি এক্সচেঞ্জের দোকানে। আমাদের ডলার গুলো সব রুপি করে পায়ে হেটেই চলে যায় শহরের খুব কাছেই অবস্থিত Ward's Lake এ। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বেশ সাজানো গোছানো এই লেকটিতে কিছুটা সময় কাটিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম Cathedral Church এর উদ্দশ্যে। লেক থেকে চার্চটির দুরুত প্রায় ৩ কিঃমিঃ তারপরও বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম হেটেই যাব। যেমন কথা তেমন কাজ বন্ধুরা মিলে জমিয়ে গল্প করতে করতে আর শিলং এর পাহাড়ি পথ বেয়ে বেয়ে পৌছে গেলাম চার্চে। বেশ উপভোগ্য চার্চেটিতে ঘন্টা খানিক সময় ঘুরে আর ছবি তুলে কাটিয়ে দিলাম। এরপর দুপুরের খাবার খেয়ে Don Bosco Museum এবং Mawphlang এই দুইটি জায়গা ঘুরার জন্য ২০০০ রুপি দিয়ে একটি গাড়ি ঠিক করে ফেলি। গাড়ি নিয়ে আমরা প্রথমেই চলে যায় মিউজিয়ামে। ৭ তলা বিশিষ্ট এই মিউজিয়ামটি বেশ মনোমুগ্ধকর। তবে এখানে প্রবেশ করতে আপনাকে গুণতে হবে প্রতিজন ২০০ রুপি করে আর আপনি যদি ছাত্র হন তবে আপনাকে দিতে হবে ১৫০ রুপি। তবে আপনাকে অবশ্যই পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে হবে। মিউজিয়াম ঘুরে আমরা রওনা হয় Mawphlang এর উদ্দেশ্যে। এটিই ছিল আমাদের দ্বিতীয় দিনের শেষ গন্তব্য। মিউজিয়াম থেকে প্রায় ২৫ কিঃমিঃ দূরে এই স্থানটিও বেশ সুন্দর। ঘন্টা দুই এই জায়গায় ঘুরে বিকাল নাগাদ আমরা ফিরে আশি শিলং পুলিশ বাজারে।
তৃতীয় দিন আমরা যেসকল জায়গা ঘুরেছিঃ Umiam Lake, Elephant Falls, Laitlum Grand Canyon (অতিরিক্ত মেঘের কারণে কিছুই দেখা যায়নি), Shillong View Point (গিয়ে ফিরে এসেছি কারণ বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশ নিষেধ)। তৃতীয় দিনেও রীতিমত গাড়ি ছিল ৮ সিটের টাটা সুমু গোল্ড এবং ভাড়া ছিল ৩৩০০ রুপি। চুক্তি ছিল ৪ টি জায়গা ঘুরিয়ে শিলং পুলিশ বাজার নামিয়ে দিবে। রাত্রি যাপনঃ শিলং পুলিশ বাজার।
তৃতীয় দিনটা আমাদের জন্য ছিল একটু হতাশারই। দিনটি ছিল রবিবার। অন্যান্য দিনের মত এই দিনেও আমরা সকাল সকাল রওনা দেই উমিয়াম লেকের উদ্দেশ্যে। দানব আকৃতির এই লেকটি অল্প সময়ে ঘুরে আসার কোন সুযোগই নেই। অপরূপ রূপে মহিমান্বিত সবুজে পাহাড়ে ঘেরা এই লেকটিতে আমারা বেশ কিছুটা সময় ঘুরে বেড়িয়েছি। যারা এই ঘুরার আনন্দের মঝে আরও একটু অতিরিক্ত আনন্দ যোগ করতে চান তারা চাইলে স্পিড বোটে চেপে এই লেকে এক পাক ঘুরে আসতে পারেন। এর আমারা চলে যায় এলিফেন্ট ফলে। উপচে পড়া পর্যটকের ভিড়ে জায়গাটি আমারা খুব একটা উপভোগ করতে না পারলেও ঝর্ণাটি ছিল অন্যান্য ঝর্ণার মতই সুন্দর। এখনে খুব একটা সময় না থেকে চলে যায় Laitlum Grand Canyon এ। মেঘে ঢেকে থাকার করণে প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করেও এই জায়গাটির কোন সৌন্দর্য উপভোগ করতে না পেরে এক রাশ হতাশা নিয়ে ফিরে আশি আমরা। এখান থেকে আমরা সোজা চলে যায় Shillong View Point এ। কিন্তু আমাদের হতাশাকে আরও এক গুণ বাড়িয়ে দিয়ে সেখানকার কর্তব্যরত কর্মকর্তারা জানিয়ে দেন এখানে বিদেশীদের প্রবেশ নিষেধ। কি আর করার হতাশ হয়েই দুপুর নাগাদ ফিরে আসিলাম শিলং পুলিশ বাজারে। বিকেলটা পুলিশ বাজারের আশেপাশে ঘুরে আর টুকটাক বাজার করে কাটিয়ে দিলাম। যদিও রবিবার বলে বেশির ভাগ বড় দোকান গুলো বন্ধ ছিল। রাতের খাবার সেরে পরবর্তী দিনের জন্য ওই একই গাড়ী ঠিক করে ফিরে যায় হোটেলে।
চতুর্থ দিন আমরা যেসকল জায়গা ঘুরেছিঃ Double Decker Living Root Bridge, Seven Sisters Falls, NohKaLikai Falls। চতুর্থ দিনেও গাড়ি ছিল ৮ সিটের টাটা সুমু গোল্ড। এই বার গাড়ি আমারা দুই দিনের জন্য চুক্তি করি। চুক্তি ছিল চতুর্থ এবং পঞ্চম দিন চেরাপুঞ্জি ঘুরিয়ে নামিয়ে দিবে ডাওকি বাজারে। ভাড়া ছিল ৭২০০ রুপি। রাত্রি যাপনঃ চেরাপুঞ্জি।
সত্যি কথা বলতে মেঘালয় ভ্রমণ পূর্ণতা পেয়েছিল চতুর্থ এবং পঞ্চম দিনে গিয়ে। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, এর মঝেও খুব সকালে হোটেল থেকে চেক আউট করে বেড়িয়ে পড়লাম চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে। প্রথম গন্তব্য Double Decker Living Root Bridge এ। বিশ্বাস করুন ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ কেমন হবে সে ধারণা আমাদের আগে থেকেই ছিল কিন্তু সেখানে যাবার পথটি কেমন হবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণাও আমাদের ছিল না। সাড়ে তিন হাজারেও অধিক পাহাড়ি এক কথায় খাড়া সিঁড়ি বেয়ে যেতে হবে আপনাকে। তাই যারা যাবেন বলে মনঃস্থির করেছেন তারা নিজেরা কতটুকু ফিট সে ব্যাপারে একটু ভেবে নিন। কারণ যাবার মধ্য পথে আপনি যদি বলেন আর যেতে পারবনা কিংবা গিয়ে ফিরার সময় বলছেন আর উঠতে পারছি না কিংবা আপনি উঠতে নামতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেলেন সেক্ষেত্রে আপনার গ্রুপের সবাই কিরূপ বেকাদায় পরে যাবে একবার ভাবুন। যারা একদিনে গিয়ে ফিরে আসতে চান তাদের মনের জোড়ের পাশাপাশি একটু ফিট থাকাও জরুরী। এছাড়াও কেউ চাইলে সেখানে একদিন থেকে পরের দিনও ফিরে আসতে পারেন। এই ব্রিজে যাওয়ার পথের সৌন্দর্যের কথা আসলে ভাষায় বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যায় হোক এই ব্রিজে যেতে আসতে আমাদের প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা সময় লেগে যায়, যা আমাদের কোন ধারণাতেও ছিল না। Double Decker Living Root Bridge থেকে ফিরে আমারা ঝটপট রওনা হয়ে যায় Seven Sisters Falls এর দিকে। এখানে পোঁছানোর পরে ঝর্ণাটির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম আর মনে মনে ভাবলাম কি অপরূপ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। ঘণ্টা খানেক সময় এখানে অতিবাহিত করে ছুটে চললাম NohKaLikai Falls এর দিকে। এযেন আরেকটি ছবির মত সুন্দর ঝর্ণা। ঝর্ণার আশেপাশের এলাকাটাও বেশ গুছানো ছিমছাম। এখানে মোটামুটি সবকিছুই পাওয়া যায়। এখানে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে আসে। এখান থেকেই আমারা ফিরে যায় রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে চেরাপুঞ্জিতে। রাত ৮ টা নাগাদ চেরাপুঞ্জিতে পোঁছেই ৩০০ রুপি প্রতি জন খরচে হোটেল ঠিক করে ঝটপট উঠে পড়ি।
পঞ্চম এবং শেষ দিন আমরা যেসকল জায়গা ঘুরেছিঃ Dainthlen Falls, Wah-Kaba Falls, Garden of Caves. শেষ দিন আমারা এই তিনটি জায়গা ঘুরব এবং সোজা চলে যাব ডাওকি বর্ডার।
বাকি চার দিনের মত আজকেও সবাই সকাল সকাল উঠে পরছি। তাড়াহুড়ো করে যে যার মত ব্যাগ গুছিয়ে হোটেল থেকে চেক আউট করে বেড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু অন্যান্য দিনের মত সবাইকে আজ খুব একটা উৎফুল্ল দেখা যাচ্ছে না। কারণ সবারই কিছুটা মন খারাপ। আজ শেষ দিন চলে যেতে হবে এই ভেবে সবাই যেন কিছুটা ঝিমিয়ে গিয়েছে। কিছুটা মন্থর মন নিয়েই পোঁছে গেলাম প্রথম জায়গা Dainthlen Falls এ কাছে। পোঁছানোর সাথে সাথে এক নিমিষেই যেন হারিয়ে গেল সব দুঃখ। এ যেন এক রূপকথার গল্পের মত সুন্দর ঝর্ণা। কি মায়াবী এর রূপ। নিমিষেই কেটে গেল ঘন্টা দুয়েক। সকাল থেকেই ঝিমঝিম বৃষ্টি যেন পিছু ছাড়ছে না, তার সাথে আছে মৃদু শীতল হাওয়া। এই আবহাওয়া মাথাই নিয়ে ছুটে চললাম Wah-Kaba Falls এর দিকে। গাড়ি এসে নামিয়ে দিল পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়ের চূড়াই নামতেই কানে ভেসে আসছে ঝর্ণার জলের ধারার শোঁ শোঁ শব্দ। মনকে কিছুতেই ধরে রাখতে পাড়লাম না। বৃষ্টি কারণে বাকিরা আপাতত নামতে অনিচ্ছা জানালেও আমারা দুই বন্ধু মিলে বৃষ্টি মাথায় করে নেমে পড়লাম ঝর্ণা দেখার উদেশে। এ যেন ঝর্ণার সর্বোচ্চ ভয়ংকর রূপ। ঝর্ণার জলধারার গতি যেন মনেও একাটা গতি এনে দিল। সে কারনেই বুঝি একবার ফিরে এসে আবার বাকি বন্ধুদের সাথে চলে গেলাম বর্ষাকালে দানব আকৃতির রূপ নেয়ে এই ঝর্ণাটিকে দেখতে। সেখান থেকেই আমাদের সর্বশেষ গন্তব Garden of Caves এ চলে গেলাম। বেশ কয়েকটি গুহা আর ঝর্ণাই বেষ্টিত এই জায়গাটি বেশ ছিমছাম এবং গুছানো। এইটাকে একটি প্রকৃতির সৃষ্টি পার্কও বলা যায়। Garden of Caves এ পোঁছাতেই এই জায়গাটির দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের ব্যবহার এবং সর্বোপরি ব্যবস্থাপনা আমাদেরকে মুগ্ধ করল। ৩০ রুপি দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম এই পার্কটিতে সাথে প্রতিটি জায়গা ভালভাবে ঘুরে দেখার জন্য দিয়ে দেয়া হল একজন গাইড। এই পার্কটিতে মোট ৭ টি ঘুরার জায়গা আছে। একে একে সব জায়গা ঘুরা শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য একটি সেডের নিচে বসলাম আর ভাবতে লাগলাম এইবার ঘরে ফেরার পালা।
সেখান থেকে বেড়িয়ে রওনা হয়ে গেলাম ডাওকি বর্ডারের উদ্দেশে। গাড়িতে যেন এক ছিমছাম নিরাবতা। গলাই গান নেই, নেই কোন হই হুল্লোর। এমতাবস্থায় আমার মনে পড়ে গেল মান্না দে’র সেই বিখ্যাত গানের দুটো লাইন “আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো।