24/02/2024
শবে বরাত : করণীয় ও বর্জনীয়
মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান(আরবি লেকচারার)
শবে বরাত এক মহিমান্বিত রজনী। এ রজনীতে দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপন বান্দাদের প্রতি বিশেষ নযর ফরমান এবং নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া সকল মুমিন বান্দাকে ক্ষমার দানে অনুগৃহীত করেন। এ রাতে আল্লাহর তরফ থেকে ঘোষণা আসে : কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিযক প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে রিযক দান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছ কি? আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্ত করব। এমনি ঘোষণা সারা রাত চলতে থাকে।
শবে বরাত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত আছে। হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
يطلع الله إلى جميع خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن
-আল্লাহ তাআলা শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) তাঁর সকল সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর মুশরিক অথবা হিংসা-বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান (অখণ্ড) পৃষ্ঠা: ১৫১৪, হাদীস নং” ৫৬৬৫)
এ হাদীসটি সহীহ। লা-মাযহাবীদের মান্যবর ইমাম শায়খ নাসিরউদ্দিন আলবানীও এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। তিনি তার ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহা’ গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করত লিখেছেন-
حديث صحيح ، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا و هم معاذ ابن جبل و أبو ثعلبة الخشني و عبد الله بن عمرو و أبي موسى الأشعري و أبي هريرة و أبي بكر الصديق و عوف ابن مالك و عائشة –
-হাদীসটি সহীহ। একদল সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে এটি বর্ণিত হয়েছে, যা একে অন্যকে শক্তিশালী করে। এ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবায়ে কিরাম হলেন- ১. হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) ২. আবূ সা’লাবা আল খুশানী (রা.) ৩. আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) ৪. আবূ মূসা আল আশআরী (রা.) ৫. আবূ হুরায়রাহ (রা.) ৬. আবূ বকর (রা.) ৭. আউফ ইবনে মালিক (রা.) ৮. হযরত আয়িশাহ (রা.)। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহা, খ- ৩, পৃষ্ঠা ১৩৫, হাদীস নং ১১৪৪)
হযরত আবূ সা’লাবা আল খুশানী (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إذا كان ليلة النصف من شعبان اطلع الله إلى خلقه فيغفر للمؤمن و يملي للكافرين و يدع أهل الحقد بحقدهم حتى يدعوه
-যখন শা’বানের মধ্যবর্তী রাত (অর্থাৎ শবে বরাত) আসে তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর মুমিনদের ক্ষমা করেন এবং হিংসুকদের তাদের হিংসার উপর ছেড়ে দেন, যতক্ষণ না তারা তা পরিত্যাগ করে। (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৮১)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
يطلع الله عز وجل إلى خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفر لعباده إلا لاثنين مشاحن وقاتل نفس
-আল্লাহ তাআলা শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) তাঁর সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। তবে দুপ্রকার ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না। ১. হিংসা বিদ্বেষপোষণকারী ২. মানুষ হত্যাকারী (মুসনাদে আহমদ, খ- ১১, পৃষ্ঠা ২১৬)।
বর্ণিত হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শবে বরাত এক মহিমান্বিত রজনী।
#শবে বরাতে আমাদের করণীয়
শবে বরাতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, তাবে-তাবিঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও সলফে সালিহীনের বিভিন্ন আমলের বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁদের অনুসরণে শবে বরাতে আমরা বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগিতে মনোনিবেশ করতে পারি। যেমন :
(ক) রাতে জাগ্রত থাকা :
ইবাদত বন্দেগির উদ্দেশ্যে শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে জাগ্রত থাকা মুস্তাহাব। আরব-অনারবে স্বীকৃত হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ফতওয়ার কিতাব ফতওয়ায়ে শামী’তে শবে বরাতে জাগ্রত থাকাকে মানদুব তথা মুস্তাহাব বলা হয়েছে। (ফতওয়ায়ে শামী, খ- ২, পৃষ্ঠা ২৫-২৭)
মারাকিল ফালাহ গ্রন্থে শবে বরাতে জাগ্রত থাকাকে মুস্তাহাব বলা হয়েছে। পাশাপাশি জাগ্রত থাকার পদ্ধতি কী হতে পারে এ বিষয়ে বলা হয়েছে-
معنى القيام أن يكون مشتغلا معظم الليل بطاعة وقيل بساعة منه يقرأ أو يسمع القرآن أو الحديث أو يسبح أو يصلي على النبي صلى الله عليه و سلم –
শবে বরাতে জাগ্রত থাকার অর্থ হলো, রাতের অধিক সময় আনুগত্যমূলক কাজে ব্যস্ত থাকা। কেউ কেউ বলেন, রাতের কিছু অংশ কুরআন তিলাওয়াত করবে অথবা তিলাওয়াত শুনবে, অথবা হাদীস পাঠ করবে কিংবা পাঠ শুনবে, তাসবীহ-তাহলীল করবে অথবা দরুদ শরীফ পড়বে। (মারাকিল ফালাহ, খ- ১, فصل في تحية المسجد وصلاة الضحى وإحياء الليالي পৃষ্ঠা ১৭৪)
(খ) কবর যিয়ারত করা এবং মৃত আত্মীয়-স্বজন ও মুসলমানদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা :
শবে বরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ আমলের মধ্যে রয়েছে যে, তিনি এ রাতে জান্নাতুল বাকী কবরস্থান যিয়ারত করেছেন এবং মৃত মুমিনদের জন্য দুআ-ইস্তিগফার করেছেন। হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) বলেছেন-
ومما ثبت من فعله صلّى الله عليه وسلم أنه أتى المقبرة ليلة النصف من شعبان ليستغفر المؤمنين والمؤمنات والشهداء
-শবে বরাতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলের মধ্যে ছাবিত আছে যে, তিনি মুমিন নারী-পুরুষ ও শহীদদের মাগফিরাত কামনার জন্য কবরস্থানে গমন করেছেন। (মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ, শাহরু শা’বান, আল মাকালাতুস সালিসাহ)
সুতরাং এ রাতে কবরস্থান যিয়ারত করা, মৃত আত্মীয় স্বজন, পিতা-মাতা ও মুসলমানদের জন্য দুআ করা, এবং তাদের মাগফিরাত কামনা করা উত্তম কাজ।
(গ) আল্লাহর দরবারে দুআ করা :
হাদীস শরীফে আছে, এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি বিশেষ নযর ফরমান। অতঃপর মুশরিক ও হিংসা বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। অন্য বর্ণনায় আছে, এ রাতে আল্লাহ পাক এই বলে আহ্বান করেন, তোমাদের মধ্যে কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো প্রার্থনাকারী কি আছে? আমি তার চাহিদা পূর্ণ করে দেব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যেই চাইবে তাকে দান করা হবে, কেবল ব্যভিচারী ও মুশরিক ব্যতীত।
সুতরাং এ রাতে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে নিজের মাগফিরাতের জন্য দুআ করা উচিত। বিশেষ করে ঐসব গুনাহের জন্য ইস্তিগফার ও তওবা করা উচিত, যেগুলো আল্লাহর রহমত লাভের অন্তরায়।
(ঘ) নফল নামায আদায় করা :
এ রাতের করণীয় আমলের অন্যতম হলো বেশি বেশি করে নফল নামায আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ সিজদা সহকারে এ রাতের দীর্ঘ সময় নামাযে অতিবাহিত করেছেন। সলফে সালিহীনগণ নামাযের জন্য এ রাতকে খাস করে নিতেন। তবে শবে বরাতের নামাযের জন্য নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই। নিজের মনের চাহিদা অনুযায়ী যত রাকাআত ইচ্ছা পড়তে পারেন, যে কোনো সূরা দিয়ে পড়তে পারেন। এ বিষয়ে কোনো শর্ত নেই। দীর্ঘ নামায পড়তে চাইলে এ রাতে সালাতুত তাসবীহ পড়া যেতে পারে।
#সালাতুত তাসবীহ-এর নিয়ম নিম্নরূপ :
চার রাকাআত সুন্নত নামাযের নিয়ত করবেন।
তাকবীরে তাহরীমার পর ছানা (সুবহানাকা আল্লাহুম্মা…) পাঠ করবেন।
তারপর নিচের তাসবীহ ১৫ বার পাঠ করবেন- سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلّهِ ولا إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَرْ
তারপর আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহসহ সূরা ফাতিহা পাঠ করবেন।
তারপর এর সাথে অন্য যে কোনো সূরা মিলিয়ে পড়বেন।
এরপর রূকূতে যাওয়ার আগে ১০ বার উপরের তাসবীহ পাঠ করবেন।
তারপর রূকূতে গিয়ে রূকূর তাসবীহ (সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম) পড়ার পর ১০ বার ঐ তাসবীহ পাঠ করবেন।
রূকূ থেকে দাঁড়িয়ে ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ পড়ার পর ১০ বার ঐ তাসবীহ পাঠ করবেন।
তারপর সিজদায় গিয়ে সিজদাহ’র তাসবীহ (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা) পড়ার পর ঐ তাসবীহ ১০ বার পাঠ করবেন।
তারপর দুই সিজদার মাঝখানের বৈঠকের তাসবীহ পাঠ করে ঐ তাসবীহ ১০ বার পাঠ করবেন।
তারপর দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে সিজদাহ’র তাসবীহ পাঠ করে ঐ তাসবীহ ১০ বার পাঠ করবেন।
এভাবে চার রাকাআত নামায পড়বেন। এতে প্রতি রাকাআতে ৭৫ বার করে চার রাকাআতে মোট ৩০০ বার উপরোক্ত তাসবীহ পাঠ করতে হয়। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খ- ১, পৃষ্ঠা-২২৩)
শায়খ ইবনে তায়মিয়া শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাতে নামায আদায় করাকে উত্তম বলেছেন। তাঁর বক্তব্য হলো-
إذا صلى الإنسان ليلة النصف وحده أو في جماعة خاصة كما كان يفعل طوائف من السلف فهو أحسن
-যদি কোনো ব্যক্তি শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে একাকী অথবা বিশেষ জামাআতে নামায আদায় করে, যেমন একদল সলফে সালিহীন করতেন, তাহলে এটা উত্তম। (আল ফাতাওয়া আল কুবরা, খ- ২, পৃষ্ঠা ২৬২)
উল্লেখ্য যে, কোনো কোনো কিতাবে শা’বানের পনের তারিখ রাতের জন্য বিশেষ নফল নামাযের কথা বলা হয়েছে। যেমন আলফিয়া নামায। এ নামাযের পদ্ধতি হলো- একশত রাকাআত নামায এভাবে পড়তে হয়, যার প্রত্যেক রাকাআতে দশবার করে সূরা ইখলাস পড়তে হবে। তবে এটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। ইবনুল জাওযী একশ রাকাআত নামায সম্পর্কিত বর্ণনাকে মাওযূ বলেছেন। মোল্লা আলী কারী (র.) শবে বরাতের বিশেষ নামায সম্পর্কিত সকল বর্ণনাকে মাওযূ বলেছেন।
(ঙ) কুরআন তিলাওয়াত ও শরীআত সম্মত অন্যান্য ইবাদত বন্দেগি করা
উপরোক্ত আমলসমূহ ছাড়াও কুরআন তিলাওয়াত, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, দান-খয়রাতসহ শরীআতসম্মত অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে এ রাত অতিবাহিত করা সওয়াবের কাজ। কেননা এসব আমল সব সময়েই উত্তম আমল হিসেবে বিবেচিত।
(চ) ১৫ শা’বান দিনে রোযা রাখা
১৫ শা’বান দিনে রোযা রাখা একটি তাৎপর্যপূর্ণ আমল। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إذا كانت ليلة النصف من شعبان ، فقوموا ليلها وصوموا نهارها
-যখন মধ্য শা’বানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিনে সিয়াম পালন করবে। (ইবনে মাজাহ, باب ما جاء في ليلة النصف من شعبان খ- ১, পৃষ্ঠা- ৪৪৪)
#শবে বরাতে বর্জনীয় কাজসমূহ
শা’বান মাস ও পবিত্র রজনী শবে বরাত মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের এক অনন্য সুযোগ। সুতরাং এ সময়ে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা আল্লাহর রহমত লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শবে বরাত নিয়ে সমাজে কিছু বিদআত ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে :
১. ঘর-বাড়ি, দোকান, মসজিদ ও রাস্তা-ঘাটে আলোকসজ্জা করা।
২. বিনা প্রয়োজনে মোমবাতি কিংবা অন্য কোনো প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা।
৩. আতশবাজি করা।
৪. পটকা ফোটানো।
৫. মাজার ও কবরস্থানে মেলা বসানো ইত্যাদি।
এ সকল বিদআত ও কুসংস্কার থেকে আমাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন।