21/01/2020
♦কক্সবাজারের মাটিতে ১০০০ PPM মাত্রার ইউরেনিয়াম ♦
এক কেজি কয়লা থেকে ৮ কিলোওয়াট ঘন্টা, এক কেজি খনিজ তেল থেকে ১২ কিলোওয়াট ঘন্টা, আর এক কেজি ইউরেনিয়াম (ইউরেনিয়াম-২৩৫) থেকে প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। অর্থাৎ তেল বা কয়লার শক্তির তুলনায় ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর শক্তি ২০ লাখ থেকে ৩০ লাখ গুণ বেশি। আর সেই ইউরেনিয়ামেরই উচ্চমাত্রায় উপস্থিতি পাওয়া গেছে কক্সবাজারের মাটি ও পানিতে। সদ্য প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে কক্সবাজারের ভ‚-গর্ভস্থ মাটিতে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল সায়েন্সডাইরেক্ট ডটকম-এ (গ্রাউন্ড ওয়াটার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর মুখপত্র) গত ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে কক্সবাজারের ভ‚-গর্ভস্থ মাটিতে থাকা জিরকন ও মোনাজাইটে ৯৯০ পিপিএম মাত্রারও বেশি ইউরেনিয়াম থাকার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
ময়মনসিংহের ত্রিশালস্থ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর, বিশিষ্ট ভ‚-রসায়নবিদ ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একদল গবেষক সম্প্রতি কক্সবাজারের ভ‚-গর্ভস্থ মাটি ও পানির নমুনা সংগ্রহ করে জাপানে পরীক্ষার পর এ ফলাফল পান। উক্ত গবেষক দলে আরো ছিলেন- জিওলজিকেল সার্ভে অফ জাপানের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ এডভান্সড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির শিক্ষক-গবেষক ইয়োশিআকি কোন, জাপানের তুকোশিমা ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ টেকনোলজি, ইন্টাস্ট্রিয়াল এন্ড সোশ্যাল সায়েন্সের শিক্ষক-গবেষক রিও আনমা, জাপানের ওসাকা সিটি ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ সায়েন্সের শিক্ষক-গবেষক হারু মাসুদা ও কেজি শিনোদা, সুইডেনের কেটিএস-ইন্টারন্যাশনাল গ্রাউন্ড ওয়াটার আর্সেনিক রিচার্স গ্রুপের ডিপার্টমেন্ট অফ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক-গবেষক প্রসূন ভট্টাচার্য্য, জাপানের দশিশা ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষক-গবেষক ইউরিকো ইউকো এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক-গবেষক বিপুলেন্দু বসাক।
পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, কক্সবাজারের ভ‚-গর্ভস্থ মাটিতে থাকা জিরকন ও মোনাজাইটে ৮৫০.৭ পিপিএম থেকে ৯৯০.৬
পিপিএম মাত্রার ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যা ইত:পূর্বে সিলেট ও মৌলভীবাজারে প্রাপ্ত আকরিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ উচ্চমানের।
২০১৫ সালে সিলেট ও মৌলভীবাজারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. একেএম ফজলে কিবরিয়ার নেতৃত্বে চালানো অনুসন্ধানে ৫০০ পিপিএম মাত্রার ইউরেনিয়াম ধরা পড়ে। ওই বছরের ডিসেম্বরে এক সেমিনারে জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সিলেট ও মৌলভীবাজারের পাশাপাশি কক্সবাজার সাগর তীরে ও ব্রহ্মপুত্র নদের বালিতে ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব থাকার তথ্য প্রকাশ করেন। তবে কক্সবাজার ও ব্রহ্মপুত্র নদের মাটিতে কী মাত্রায় কিংবা কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম রয়েছে সে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
সারাবিশ্বে ভিন্ন মাত্রার ইউরেনিয়াম ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতিতে পাওয়া ইউরেনিয়াম পারমানবিক চুল্লীতে সমৃদ্ধ করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়। প্রকৃতিতে পাওয়া ইউরেনিয়ামকে ০.৭% থেকে ৩.৭ পর্যন্ত এবং ৩.৭ থেকে ৫% মাত্রায় সমৃদ্ধ করা হয়। তবে ২০% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকে বলা হয় উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম (এইচআরইউ)। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রচুর পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দরকার।
আর সেই ইউরেনিয়ামের যোগান দেশ থেকে আসতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী জানান, কক্সবাজারে চালানো সাম্প্রতিক ওই গবেষণা অনুসন্ধানের জন্য ভ‚-পৃষ্ঠের সর্বোচ্চ ১৮.৯ মিটার গভীর থেকে মাটি সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে ৩ মিটারের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি জিরকন ও মোনাজাইট পাওয়া যায়।
তিনি জানান, কক্সবাজারের মাটিতে ১.১ পিপিএম থেকে ৩৩.৪ পিপিএম পর্যন্ত ইউরেনিয়াম এবং ৬.৩ পিপিএম থেকে ২০২.৩ পিপিএম থোরিয়াম পাওয়া যায়। আর এই মাটিতে মোনাজাইটের পরিমাণ ৩.২৮% ভাগ এবং জিরকন এর পরিমাণ ২.৩৬% ভাগ। আর মোনাজাইট এবং জিরকন কনা নিজেই ৩৩৯৫.৯ পিপিএম থেকে ৩৯৩৭.৫ পিপিএম পর্যন্ত থোরিয়াম এবং ৮৫০.৭ থেকে ৯৯০.৬ পিপিএম পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ। যা সাধারণ মাত্রার তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ। সাধারণ মাত্রায় থোরিয়াম থাকে ২৭৫.৫ পিপিএম থেকে ৩১৮.৪ পিপিএম এবং ইউরেনিয়াম থাকে ২৫৬.৩ পিপিএম থেকে ২৯০.৫ পিপিএম পর্যন্ত। সুতরাং বলা যায়, এটা বেশ সমৃদ্ধ এবং কম গভীরতায় থাকায় উত্তোলনও হবে খুব লাভজনক।
গত কয়েক বছর আগে কক্সবাজারের ভ‚-গর্ভস্থ পানীয় জলের নমুনা পরীক্ষা করে ১০ পিপিএম মাত্রার ইউরেনিয়াম এর অস্তিত্ব পান বিজ্ঞানী ড. আশরাফ। যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা হু নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৫ গুণ বেশি। হু নির্ধারিত সহনীয় মাত্রা হল ২ পিপিএম ( পার্টস পার মিলিয়ন বা ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ)। আর এ ফলাফলের পরই কক্সবাজারের মাটিতে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম থাকার সম্ভাবনা থেকে তিনি সম্প্রতি ওই জরীপ চালান বলে জানান।
গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী জানান, তার গবেষণায় মোনাজাইটের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার (১৬%) ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। রুটাইল, জিরকন ও ইলমেনাইটেও তেজস্ক্রিয় পদার্থ মিশে থাকে।
ইউরেনিয়াম একটি ঘন, রূপালী-সাদা, সামান্য প্যারাম্যাগনেটিক তেজস্ক্রিয় ধাতু। এটি নমনীয় এবং ক্ষতিকারকও। ইউরেনিয়ামের কালো স্তর অক্সাইডের মাধ্যমে বাতাসকে দূষিত করে। ইউরেনিয়াম একটি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল ধাতু এবং প্রায় সমস্ত ননমেটালিক উপাদান এবং তাদের অনেকগুলি যৌগের সাথে প্রতিক্রিয়া করে। এটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি ভারী ধাতু, যা ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘনীভূত শক্তির প্রাচুর্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পৃথিবীর ভূ-ত্বকে টিন, টাংস্টেন এবং মলিবডেনমের মতোই সাধারণ একটি খনিজ ইউরেনিয়াম। সাধারণত: ২ থেকে ৪ পিপিএম ঘনত্বের পাথরেই ইউরেনিয়াম দেখা যায়। ইউরেনিয়াম সমুদ্রের পানিতে জন্ম নেয় এবং সেখান থেকেও আহরণ করা যায়। তবে ভ‚-পৃষ্ঠের নীচে বা পানিতে; যেখানেই ইউরেনিয়াম থাকুক না কেন সেখান থেকে তেজস্ত্রিয়তা বের হয়। এতে উপাদানটি চিহ্নিত করা সহজ। তবে কক্সবাজারের ভ‚-গর্ভস্থ মাটিতে ইউরেনিয়ামের কী পরিমাণ মজুদ রয়েছে বা সাগরের পানিতে কী মাত্রায় রয়েছে, তা নিয়ে কোন গবেষণা হয়নি।
কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় বালিতে ভারি খনিজ সম্পদের উপস্থিতির তথ্য প্রথম জানা যায় ১৯৬১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান ভূতাত্তি¡ক জরিপ অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন এই ভারি খনিজ সম্পদের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৯৬৭ সালে দুইজন অস্ট্রেলীয় বিশেষজ্ঞের সহায়তায় দেশের দক্ষিণ-পূব উপকূলীয় অঞ্চলের বালিতে ভারি খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, জরিপ, বালির নমুনা বিশ্লেষণ, খনিজের পরিমাণ নির্ধারণ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের ওপর গবেষণা কাজ শুরু করা হয়। এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওই বছরই পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন ‘ডাইরেক্টর অব নিউক্লিয়ার এন্ড মিনারেলস (ডি,এন,এম)’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে, যার প্রধান কার্যালয় ছিল পাকিস্তানের লাহোরে। আর একটি আঞ্চলিক অফিস স্থাপন করা হয় চট্টগ্রামে। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম অফিস হতে ধারাবাহিকভাবে ভারি খনিজ বালি অনুসন্ধান ও জরিপের কাজ শুরু করা হয় এবং ওই বছরেই ওই প্রকল্পের প্রথম ধাপটি শেষ করা হয়। বাংলাদেশের ৫৫০ কিঃমিঃ দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলে ‘ভারি খনিজ বালি অনুসন্ধান ও জরিপে’ ১৭টি স্তুপের মধ্যে পাওয়া ৮টি মূল্যবান খনিজ পদার্থের মধ্যে মোনাজাইট ও জিরকনের মত তেজস্ক্রিয় পদার্থও রয়েছে বলে জানান পরমাণু শক্তি কমিশনের কক্সবাজারস্থ খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রের সাবেক ভ‚-তত্ত¡বিদ ও গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী।
সোর্স:- কক্সবাজার নিউজ