27/11/2021
ছবিতে পুরাতন কাবাঘর
কাবা, কাবাঘর, কাবা শরীফ (আরবি: الكعبة al-Ka‘bah), আরও যে নামে পরিচিত
একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত, যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে। মসজিদ আল-হারাম (আরবি: المسجد الحرام) ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান যা কাবাকে ঘিরে অবস্থিত।সৌদি আরবের মক্কা শহরে এর অবস্থান। মুসলিমরা নামাজের সময় কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। হজ্জ ও উমরার জন্যও মসজিদুল হারামে যেতে হয়। মসজিদ আল-হারামের ধারণক্ষমতা ৯,০০,০০০ মুসল্লি (হজ্জের সময় ৪০,০০,০০০ তে উন্নীত হয়)। মিনার রয়েছে ৯টি। প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৮৯ মিটার (২৯২ ফুট)।
কুরআনে বর্ণিত রয়েছে যে, ইবরাহিম (আ) ও ইসমাইল (আ) দুজন একত্রে কাবা নির্মাণ করেন। ইবরাহিম (আ) কাবার পূর্ব কোণে হাজরে আসওয়াদ পাথর স্থাপন করেছিলেন যা হাদিস অনুযায়ী বেহেশত থেকে আগত। এই পাথর একসময় দুধের মত সাদা ছিল কিন্তু মানুষের গুনাহর কারণে এটি কালো হয়ে পড়ে। ইবরাহিম (আ) এর নির্মিত কাবার মধ্যে এই পাথরটিই একমাত্র আদি বস্তু হিসেবে টিকে রয়েছে। কাবা নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ইবরাহিম (আ) কে হজ্জের জন্য আহ্বান করতে আদেশ দেয়া হয়। কুরআনের সূরা হজ্জে উল্লেখ আছে
“আর মানুষের কাছে হজ্জ ঘোষণা করে দাও। ওরা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেটে ও ধাবমান উটের পিঠে চড়ে, আসবে দুরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে।”
(সূরা হজ্জ, আয়াত ২৭)
কাবা ২১৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে নির্মিত হয় বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। ইসলাম অনুযায়ী কাবা পৃথিবীর প্রথম ইবাদতের স্থান। পি রাথমিকভাবে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলেও কালক্রমে কাবা পৌত্তলিকতার চর্চা শুরু হয়। মক্কা বিজয়ের আগে এখানে ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল। মুহাম্মদ (সা) এর মক্কা বিজয়ের পর কাবার মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়। ফলে কাবায় পৌত্তলিকতার চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মসজিদুল হারামের নির্মাণ বিভিন্ন সময়ে সম্পাদিত হয়। ৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে প্রথম বড় আকারের সংস্কার সাধিত হয়। এর পূর্বে মসজিদ ছিল কাবাকে কেন্দ্র করে একটি খোলা স্থান। সংস্কারে ছাদসহ দেয়াল দিয়ে এলাকাটি ঘিরে দেয়া হয়। ৮ম শতাব্দীর শেষ নাগাদ মসজিদের পুরনো কাঠের স্তম্ভগুলোর বদলে মার্বেলের স্তম্ভ স্থাপন করা হয় এবং নামাজের স্থান বৃদ্ধিসহ মিনার যুক্ত করা হয়। ইসলামের প্রচার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে হাজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মসজিদে আরো সংস্কার করা হয়। ১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় সেলিম প্রধান স্থপতি মিমার সিনানকে মসজিদ পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন। এই পুনর্নির্মাণের সময় সমতল ছাদগুলোর বদলে ক্যালিগ্রাফি সম্বলিত গম্বুজ ও নতুন স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। এগুলো বর্তমান মসজিদের সবচেয়ে পুরনো প্রত্ননিদর্শন। ১৬২১ ও ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কাবা ও মসজিদ আল হারামের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান চতুর্থ মুরাদের শাসনামলে কাবা পুনর্নির্মিত হয় এবং মসজিদ আল হারাম সংস্কার করা হয়। মসজিদ সংস্কারের সময় পাথরের নতুন খিলান নির্মিত হয় এবং তিনটি নতুন মিনার যুক্ত করা হয়। মেঝেতে মার্বেলের আচ্ছাদন নতুন করে স্থাপিত হয়। এরপর প্রায় তিনশত বছর মসজিদের রূপ অপরিবর্তিত ছিল।
সৌদি শাসন শুরু হওয়ার পর ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বড় আকারের সংস্কার সাধিত হয়। এসময় আরো চারটি মিনার যুক্ত করা হয়, ছাদ সংস্কার করা হয় এবং মেঝে পাথর ও মার্বেল দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। সাফা ও মারওয়াকে এসময় মসজিদের দালানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংস্কারের সময় উসমানীয় যুগের অনেক অংশ বাদ দেয়া হয়েছিল। বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজের শাসনামলে দ্বিতীয়বার সংস্কার করা হয়। এসময় নামাজের নতুন স্থান এবং বাইরে নামাজ পড়ার স্থান যুক্ত করা হয়। এই নতুন অংশে কিং ফাহাদ গেট দিয়ে প্রবেশ করা যায়। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৮৮ থেকে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তৃতীয় সৌদি সম্প্রসারণ সম্পন্ন হয়। এসময় আরো মিনার যুক্ত করা হয়। সেসাথে আরাফাত, মিনা, মুজদালিফাতেও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়। তৃতীয় সম্প্রসারণে ১৮টি নতুন ফটক যুক্ত করা হয়, প্রায় ৫০০টি মার্বেল স্তম্ভ যুক্ত করা হয়, তাপ নিয়ন্ত্রিত মেঝে, এয়ার কন্ডিশন, চলন্ত সিড়ি ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা যুক্ত হয়। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ আল হারামের চতুর্থ সম্প্রসারণ কার্য শুরু হয় যা ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ মসজিদের ধারণ ক্ষমতা ২০ লক্ষে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহ মারা যাওয়ার পর তার উত্তরসূরি সালমান বিন আবদুল আজিজ এই সম্প্রসারণ চালু রেখেছেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর সম্প্রসারণের সময় ব্যবহৃত একটি ক্রেন ঝড়ে ভেঙে পড়ায় ১১১ জন মারা যান। মসজিদুল হারাম ইসলামের প্রধানতম মসজিদ। এখানে অবস্থিত কাবার দিকে ফিরে মুসলিমদের নামাজ পড়তে হয়। হজ্জ ও উমরার সময়ও মসজিদুল হারামে উপস্থিত হতে হয়। কাবা মুসলিমদের কিবলা। যেকোনো নামাজ পড়ার সময় এর দিকে ফিরতে হয়। মুহাম্মদ (সা) নবুয়ত লাভের পর প্রথমে মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ পড়তে হত। হিজরতের পর কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী কাবাকে কিবলা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। মসজিদে কিবলাতাইনে এ বিষয়ক কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছিল।
ইসলাম ধর্ম মতে কাবা কে সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে মনে করা হয়। এটি মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ পরেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিন করেন।
কাবা একটি বড় পাথরের কাজ করা কাঠামো যার আকৃতি প্রায় একটি ঘনক এর মত। কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকা'আব অর্থ ঘন থেকে। এটি কাছের পাহাড়ের গ্রানাইট দ্বারা তৈরি যা দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ২৫সেঃমিঃ (১০ ইঞ্চি) মার্বেল পাথরের ভিত্তির উপর যা বাইরের দিকে ৩০সেঃমিঃ (১ ফুট) বাড়িয়ে আছে। কাঠামোতে জায়গার পরিমাণ প্রায় ১৩.১০ মিঃ (৪৩ ফুট) উচ্চতা, পাশাপাশি ১১.০৩ মিঃ X ১২.৬২ মিঃ। চারটি কোন কম্পাসের প্রায় চার বিন্দু বরাবর মুখ করা। কাবার পূর্ব কোনা হচ্ছে রুকন-আল- আসওয়াদ" (কাল পাথর অথবা "আল-হাজারুল-আসওয়াদ"), একটি উল্কাপিন্ডের অবশেষ; উত্তর কোনা হল "রুকন-আল-ইরাকী" (ইরাকী কোণ); পশ্চিমে রয়েছে "রুকন-আল-সামী" (পূর্ব-ভূমধ্য সাগরীয় কোণ) এবং দক্ষিণে "রুকন-আল-ইয়ামানী" ('ইয়েমেনী কোণ')। কাবা কালো সিল্কের উপরে স্বর্ণ-খচিত ক্যালিগ্রাফি করা কাপড়ের গিলাফে আবৃত থাকে। কাপড়টি কিসওয়াহ নামে পরিচিত ; যা প্রতিবছর পরিবর্তন করা হয়। কালেমা শাহাদাত এ কাপড়ের মধ্যে সুতা দিয়ে লিখার কাঠামো তৈরি করা হয়। এর দুই তৃতীয়াংশ কোরানের বাণী স্বর্ণ দিয়ে এম্রোয়ডারি করা হয়।
বর্তমানে গিলাফ কালো রেশমী কাপড় নির্মিত, যার ওপর স্বর্ণ দিয়ে লেখা থাকে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ", "আল্লাহু জাল্লে জালালুহু", "সুবহানাল্লাহু ওয়া বেহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযিম" এবং "ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান"। ১৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৫ সেমি প্রস্থ ৪১ খণ্ড বস্ত্রখণ্ড জোড়া দিয়ে গিলাফ তৈরি করা হয়। চার কোণায় সুরা ইখলাস স্বর্ণসূত্রে বৃত্তাকারে উৎকীর্ণ করা হয়। রেশমী কাপড়টির নিচে মোটা সাধারণ কাপড়রের লাইনিং থাকে। একটি গিলাফে ব্যবহৃত রেশমী কাপড়ের ওজন ৬৭০ কিলোগ্রাম এবং স্বর্ণের ওজন ১৫ কিলোগ্রাম। বর্তমানে এটি তৈরীতে ১৭ মিলিয়ন সৌদী রিয়াল ব্যয় হয়। কাবা শরীফকে গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন কখন বা কার উদ্যোগে শুরু হয় সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। একটি ঐতিহাসিক সূত্রানুযায়ী নবী হযরত ইসমাঈল (আ.) প্রথম পবিত্র কাবা শরীফকে গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন করেন। ভিন্ন আরেকটি বর্ণনায় আছে যে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্ব পুরুষ আদনান ইবনে আইদ পবিত্র কাবা শরীফকে প্রথম গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদিত করেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবু কবর আসাদই সম্ভবতঃ পবিত্র কাবা শরীফ গিলাফ আচ্ছাদনকারী প্রথম ব্যক্তি। ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইয়াসরিব শহরে (অর্থাৎ, মদীনা শহর) হিজরতের ২২০ বৎসর আগে হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবু কবর আসাদ এই শহরটিতে (ইয়াসরিব) আক্রমণ করেন। তুব্বা আবু কবর আসাদ ইয়াসরিব ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফ করত: মাথা মুণ্ডন করেন। অত:পর তিনি এই শহরে কয়েকদিন অবস্থান করেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি ঘুমের মধ্যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি কাবা শরীফ গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন করছেন। এ স্বপ্ন দ্বারা প্রাণিত হয়ে অবিলম্বে "খাসাপ" দ্বারা কাবাঘরটি আচ্ছাদিত করেন। "খাসাপ" হচ্ছে তালগাছ জাতীয় গাছের পাতা ও আঁশের তৈরি এক ধরনের মোটা কাপড়। অনন্তর তিনি আবার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি আরো উন্নতমানের কাপড় দ্বারা কাবা শরীফ আচ্ছাদন করছেন। অত:পর তিনি খাসাপের পরিবর্তে মামিজিয়ান, পাপিরাস (মিশর দেশীয় নলখাগড়া বিশেষ পাতা) দ্বারা কাবা ঘর আচ্ছাদন করেন। ইয়েমেনের মামিজ নামক একটি উপজাতীয় গোত্র এই কাপড় তৈরি করতো। এরপরও তৃতীয়বারের মতো তিনি স্বপ্নে আরো উন্নত মানের কাপড় দ্বারা কাবা আচ্ছাদনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তৃতীয় দফা স্বপ্নটির পর তিনি ইয়েমেনের লাল ডোরাকাটা কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবা ঢেকে দিয়েছিলেন। তুব্বা আবু কবর-এর রীতি অনুযায়ী মক্কার স্থানীয় লোকজন সুন্দর কাপড় বা গিলাফ দিয়ে পবিত্র কাবাঘর আচ্ছাদন করতে থাকে এবং তা নিয়মিত প্রথায় পরিণত হয়। বর্তমানে দামী কালো রং সিল্কের কাপড়ের তৈরি স্বর্ণ-খচিত ক্যালিগ্রাফি মোটা গিলাফ দিয়ে কাবা শরীফ আচ্ছাদন করা হয়। কাপড়টি কিসওয়াহ নামে আখ্যায়িত। আব্বাসীয় খলিফা আল আব্বাস আল মাহদী ১৬০ হিজরীতে পবিত্র হজ্ব পালনকালে পবিত্র কাবা থেকে একটি ছাড়া সবগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। এখনো এই ধারাই অব্যাহত রয়েছে। ৭ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের আগে মুহম্মদ (সা:) গিলাফ পরানো শুরু করেননি। অত:পর গিলাফ পরানোর সংস্কৃতি অব্যাহত থাকে। বাদশাহ বাইবার্স হচ্ছেন পবিত্র কাবায় গিলাফ পরিয়ে দেয়া প্রথম মিশরীয় শাসক। তারপর ইয়েমেনের বাদশা আল মুদাফ্ফার ৬৫৯ হিঃ কাবা শরীফে গিলাফ পরান। পরবর্তীতে মিসরের শাসকরা পর্যায়ক্রমে এ কাজ অব্যাহত রাখেন। বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সউদ মক্কা-মদীনার দুই পবিত্র মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর ১৩৪৬ হিজরিতে কাবা শরীফের গিলাফ তৈরির জন্য একটি বিশেষ কারখানা স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করেন। একই বৎসর মাঝামাঝি সময়ে প্রয়োজনীয় কাপড় তৈরি করে মক্কার দক্ষ শিল্পীর মাধ্যমে তা সুন্দর নকশায় সুসজ্জিত করে কাবা শরীফ আচ্ছাদিত করা হয়। ১৩৫৭ হিজরী পর্যন্ত এই কারখানাটি গিলাফ বা "কিসওয়াহ" তৈরি অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে ১৩৮১ হিজরীতে সৌদি হজ্জ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দক্ষ সৌদি কারিগর দ্বারা রেশমী ও সোনালী সুতা দিয়ে গিলাফ তৈরি করে কাবার গায়ে পরিধানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৩৮২ হিজরীতে বাদশাহ ফয়সাল ইবনে আব্দুল আজিজ নতুন ডিক্রিজারির মাধ্যমে নতুন করে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। খাঁটি প্রাকৃতিক রেশমী রং এর সাথে কালো রং-এর কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে কুরআনের কিছু আয়াত শোভা পায়। অক্ষরগুলো সোনালী আভায় উদ্ভাসিত। প্রতি বৎসর হজ্জের ঠিক আগে কাবা শরীফের গিলাফ সরিয়ে তা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। হাজীদের ইহরামের শ্বেতশুভ্রতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই সাদা গিলাফ পরানো হয়। হজ্জ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১০ জিলহজ্জ তারিখে নতুন গিলাফ পরানো হয়। প্রতিস্থাপতি গিলাফটি খণ্ড খণ্ড করে বিলিয়ে দেয়া হয়।
তাওয়াফ হল কাবা ঘরের চারপাশে ৭ বার প্রদক্ষিণ করা, ঘড়ির বিপরীতমুখী ( Counter clock-wise direction) হয়ে । কাবার চারদিকে একত্রে ঘুরে মুসলমানেরা এক আল্লাহ্র একাত্মতা প্রকাশ করার জ্বলন্ত উদাহরন ।তাওয়াফ শুরুর পূর্বে হজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া নিয়ম। তবে ভিড়ের কারণে এর কাছে যাওয়া সম্ভব না হলে হাত দিয়ে ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করতে হয়।
হাজরে আসওয়াদ (আরবি: الحجر الأسود al-Ḥajar al-Aswad বাংলা:কালো পাথর) হল একটি কালো রঙের প্রাচীন পাথর যা কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার (চার ফুট) উঁচুতে অবস্থিত। মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী এই পাথর আদম ও হাওয়ার সময় থেকে পৃথিবীতে রয়েছে। প্রাক ইসলামি পৌত্তলিক সমাজেও এই পাথরকে সম্মান করা হত। ইসলামি বর্ণনা অনুযায়ী, রাসুল মুহাম্মদ (সা) ৬০৫ সালে এটি কাবার দেয়ালে স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে এটি একটি রূপার ফ্রেমে আটকানো অবস্থায় কাবার সাথে সংযুক্ত রয়েছে। এর রং গাঢ় কালো এবং লক্ষাধিক হাজির স্পর্শের কারণে এটি মসৃণ আকার লাভ করেছে। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী এটি আদম ও হাওয়ার সময় বেহেশত থেকে পৃথিবীতে এসে পড়ে। এটিকে একটি উল্কা বলা হলেও এর সত্যতা নিশ্চিত না। হজ্জ বা উমরার অংশ হিসেবে মুসলিমরা তাওয়াফ করে থাকেন। এর শুরুতে হাজরে আসওয়াদ চুমু দেয়া রীতি রয়েছে। ফ্রেমে মুখ ঢুকিয়ে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করতে হয়। এর পাশে ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থাকে সৌদি পুলিশ। তারা খেয়াল রাখে, ফ্রেমে মাথা ঢোকাতে বা চুম্বন করতে কারও যেন কষ্ট না হয়। তবে চুমো দেয়া সম্ভব না হলে হাত ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করা হয়।
ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর সময়ে পবিত্র কাবাঘর পুনর্নির্মাণের পর হাজরে আসওয়াদকে আগের জায়গায় কে বসাবেন—এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরতে বলেন এবং দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান। এই পবিত্র পাথরের দৈর্ঘ্য ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। বর্তমানে এটি আট টুকরো। আগে হাজরে আসওয়াদ ছিল আস্ত একটি পাথর। হজরত আবদুল্লাহ বিন জোবায়েরের শাসনামলে কাবা শরিফে আগুন লাগলে হাজরে আসওয়াদ কয়েক টুকরা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের পরে ভাঙা টুকরাগুলো রুপার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেন। ফ্রেম সংস্করণের সময় চুনার ভেতর কয়েকটি টুকরা ঢুকে যায়। বর্তমানে হাজরে আসওয়াদের আটটি টুকরা দেখা যায়। বড় টুকরাটি খেজুরের সমান।
কাবার ইতিহাস:
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ফেরেশতারা কাবাঘর নির্মাণ করেন। কাবাঘরকে উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা আল-ইমরানের ৯৬ আয়াতে বলেন, “নিশ্চই সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের ইবাদত রূপে নিরূপিত হয়েছে, তা ঐ ঘর যা মক্কাতে অবস্থিত”।
কাবাঘরটি আল্লাহ তায়ালার আরশে মুয়াল্লাহ’র ছায়াতলে সোজাসুজি বাইতুল মামুরের আকৃতি অনুসারে স্থাপন করেন। হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) উভয়ই আল্লাহ তায়ালার কাছে ইবাদতের জন্য একটি মসজিদের পার্থনা করেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের দোয়া কবুল করেন এবং বাইতুল মামুরের আকৃতিতে পবিত্র কাবাঘর স্থাপন করেন। এখানে হযরত আদম (আঃ) সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতে থাকেন (শোয়াব-উল-ঈমান, হাদিসগ্রন্থ) এর অনেক তফসিরবিদের মতে, মানব সৃষ্টির বহু আগে মহান আল্লাহ তায়ালা কাবাঘর সৃষ্টি করেন”।
হফসিরবিদ মজাহিদ কলেন, “আলস্নাহ রাব্বুল আলামিন মুয়াল্লাহ’র স্থানকে সমগ্র ভুপৃষ্ঠ থেকে দু’হাজার বছর আগে সৃষ্টি করেন”। মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে হযরত আবুযর গিফারী হতে বর্ণনা হয়েছে, রাসূল (সঃ) তার একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ হলো মসজিদে হারাম। এরপরের মসজিদ হলো মসজিদে আকসা। মসজিদে হারাম নির্মাণে ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা নির্মিত হয়।”
হযরত আদম (আঃ) কাবাঘর আল্লাহ তায়ালার আদেশে পুনঃনির্মাণ করেন। এরপর বহুদিন অতিক্রম হলো। শত শত বছর অতিবাহিত হলো। আল্লাহ তায়ালার বান্দারা কাবাঘর জিয়ারত করতো,আল্লাহ তায়ালার কাছে হাজিরা দিতো এ কাবাঘরে সমবেত হয়ে। কাবাঘরে এসে মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্রতা ও অংশীদারহীনতা ঘোষণা দিত। “লাব্বাইক আল্লা হুম্মা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা, লাকাওয়ালা মুলক, লাশারিকা, লাকা লাব্বাইক”।
এভাবে চলতে চলতে দিন গত হতে থাকলো। এরপর হযরত শীস (আঃ) কাবাঘর পুনঃনির্মাণ করলেন। দিন দিন এবাদতকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। এরপর কাবা শরীফ নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ করেন হযরত ইব্রাহীম (আ;)। হযরত ইব্রাহীম (আ·) হযরত ইসমাইল (আ·) কে সাথে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ বা পুননির্মাণ করেন। হযরত ইব্রাহীম (আ·) কাবাঘর সংস্কার করে আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করলেন। ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে আজ্ঞাবহ কর।’ আমাদের বংশ থেকে একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজ্বের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের রহমত কর। নিশ্চই তুমি দয়ালু। হে প্রতিপালক!
তাদের মধ্যে থেকেই তাদের কাছে একজন পয়গম্বর প্রেরণ করলেন। যিনি তাদের কাছে তোমাদের আয়াত তেলাওয়াত করবেন। তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন এবং পবিত্র করবেন। নিশ্চই তুমি মহাপরাক্রমশালী”। আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর বংশ হতে হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে শেষ নবী ও রাসূল হিসাবে আল্লাহ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। এরপর কয়েকশ’ বছর গত হলো। পবিত্র কাবাঘর সংস্কার করলো আমালিকা সম্প্রদায়। তারপর আরো শ’ শ’ বছর কিংবা হাজার হাজার বছর পরে কাবাঘর সংস্কার করলো মক্কার জুরহাস সম্প্রদায়। আরবের অর্থাৎ মক্কায় যে সকল গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি ছিল, তাদের দায়িত্ব থাকতো কাবা শরীফ দেখাশুনার। এ দায়িত্ব পালনকে তারা সম্মানিত ও গর্বের মনে করতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হলো। কাবা শরীফ ও কাবাঘরকে সংস্কার করলেন মোযার সম্প্রদায়। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) নবুয়্যত প্রাপ্তির ৫ বছর আগে কাবাঘর সংস্কার করে মক্কার বিখ্যাত কোরাইশ বংশ। এ কোরাইশ বংশেই মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ৫৭০ খ্রীঃ · জন্মগ্রহণ করেন। কোরাইশরা কাবা শরীফ সংস্কারের পর হাযরে আসওয়াত স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়।
সকলের সম্মতিক্রমে আল্লাহর রাসূল কাবাগৃহে হাযরে আসওয়াদ কাবা শরীফে স্থাপন করেন। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) জীবিত অবস্থায় ৬৪ হিজরীতে আব্দুলস্নাহ ইবনে জোবায়ের (রাঃ) কাবা শরীফ সংস্কার করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৭৪ হিজরীতে কাবা শরীফ সংস্কার করেন। সুদীর্ঘ ১৪শ’ বছরে কাবাগৃহে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হয়নি। শুধুমাত্র কাবাঘরের চারপাশে অবস্থিত মসজিদে হারামের পরিবর্ধন, সংস্কার বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাবাঘরের রক্ষণাবক্ষণের দায়িত্ব সৌদি রাজপরিবারের। সৌদি সরকারের প্রধান (বাদশাহ) কাবা শরীফের মোতোয়াল্লির দায়িত্বে থাকেন। ভৌগলিক দিক দিয়ে মক্কা ও আরব উপদ্বীপ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যস্থলে অবস্থিত। মক্কানগরী পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় মহান আল্লাহর কাবাঘর মক্কাতেই স্থাপন করেন। পবিত্র হজ্ব পালন করতে লাখ লাখ মুসলমান মক্কা শরীফে গমন করেন। জিলহজ্ব মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মূল হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়। জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ ঈদুল আযহার দিন। এ দিন কোরবানী দিতে হয়। যা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর স্মৃতি বহন করে চলছে হাজার হাজার বছর ধরে। যমযম কূপ ও ঠিক তেমনি হযরত ইসমাইল (আঃ) ও তার মা বিবি হাজেরা (আঃ)-এর স্মৃতি বহন করে চলছে। এ যমযম কূপ মহান আল্লাহর কুদরতের অপূর্ব মহিমার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। হজ্ব মুসলমানদের ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ। আরবের মক্কা নগরীর পবিত্র কাবাঘর হেফাজতের মালিক মহান আল্লাহ্ নিজে।