27/01/2023
৩ ডিসেম্বর , ২০২১। ১৬ তম বাংলা চ্যানেল সাঁতারের বাছাইপর্ব (১৬.১ কিলোমিটার সমুদ্র পথ সাঁতার বাংলা চ্যানেল সাঁতার নামে পরিচিত)।
ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল ৭ টা বাজে, দেরি হয়ে গেছে অনেক । এখন রওনা হলে পৌছানো যাবেনা সময়ের মধ্যে । ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে দেখি নাঈম এখনই উঠেছে । নয়ন তখনও ওঠেনি । সাইফুল উঠে আবার ঘুমিয়ে গেছে । হলো না এবার বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করা । তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ২০ তারিখ শাহপরীর দ্বীপ থেকে দেখব বাংলা চ্যানেল সাঁতার । কিন্তু কথা হল ঢাকা থেকে যাব কিভাবে !
সম্পূর্ণ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত টা হেঁটে দেখার ইচ্ছা ছিল আগে থেকেই । ব্যাস সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম মেইল ট্রেনে চট্টগ্রাম, বাসে কক্সবাজার, কক্সবাজার থেকে শাহপরীর দ্বীপ হেঁটে যাব।
১৬ ই ডিসেম্বর , ২০২১। শেষ পর্যন্ত যাচ্ছি ইনশাআল্লাহ আমরা ৩ জন । বিকালে রওনা হলাম কমলাপুরের উদ্দেশ্যে । কক্সবাজার থেকে শাহপরীর দ্বীপ প্রায় ৯০ কিলোমিটার । ভাবলাম কিভাবে এটাকে শতক বানানো যায় । বাস থেকে নেমে পড়লাম শ্যামলী । হেঁটে গেলাম কমলাপুর।
রাত প্রায় ৯টা, দুই নাম্বার প্লাটফর্মে অপেক্ষা করছি চট্টগ্রাম মেইল এর জন্য । আরও কিছু সফর সঙ্গী পেলাম আমরা । প্ল্যাটফর্মের শেষ অংশে দাঁড়িয়ে আছি সবাই । উদ্দেশ্য প্লাটফর্মে আসা অবস্থায় চলন্ত ট্রেনে ওঠে সিট দখল করা। (চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের টিকিটে কোন সিট নাম্বার থাকে না। আবার সাধারণ মানুষের জন্য থাকে মাত্র ২-৩ টা বগি। এদিকে ভাড়া ১২৫ টাকা হওয়ায় ভীড়ও হয় অনেক। তো সিট যিনি ধরতে পারবেন গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত সিট তার।
ঐ তো ট্রেন দেখা যাচ্ছে, ঝকঝক করে এগিয়ে আসছে। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে লাফিয়ে উঠার। জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত বগি কাছে আসতেই লাফিয়ে উঠলাম দুজন । ধরে ফেললাম সিট। সাড়ে ১০ টা নাগাদ শুরু হল আমাদের যাত্রা । বাসা থেকে আনা ভাত খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম । পরদিন চট্টগ্রাম পৌঁছে ধরলাম কক্সবাজারের বাস । ভাড়া ২০০ টাকা । রাতটা থেকে গেলাম কক্সবাজারের এক মসজিদে।
১৮ ডিসেম্বর , ২০২১। সাড়ে ৬ টা থেকে শুরু হল আমাদের বিচ হাইকিং শৈবাল বিচ পয়েন্ট থেকে । পরিকল্পনা প্রায় পুরো ১০০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত স্বচক্ষে দেখা । পথে কোন খাল পড়লে রাস্তায় উঠে পার হওয়া । শুরুতেই পর্যটকদের ভিড় কিন্তু আজ খারাপ লাগছে না ভিড় টা কারণ একটু দূরেই অপেক্ষা করছে সম্পূর্ণ ফাঁকা সমুদ্র সৈকত । একটু সামনে যেতেই বড় হতে লাগল হিমছড়ির পাহাড় গুলো উল্টোদিকে পেছনে ছোটো হতে লাগলো হোটেল গুলো । পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে গাঙচিলের পাল । আকাশটা আজ দারুন সুন্দর , পানির রংটাও । একটু দূরে যেতেই দেখলাম বাচ্চারা ডাংগুলি খেলছে , দেখলাম স্টারফিশ , জেলিফিশ আর সামুদ্রিক সাপ । আরেকটু যেতেই পিছু নিল একটা মা কুকুর, আমাদের সাথে অনেক দূর হাঁটলো সে ।
জনমানব শূন্য সৈকত , ডানে দিগন্ত বিস্তৃত সাগর , বামে ঝাউবন আর পাহাড় । এর মাঝে হেটে চলেছি আমরা তিনজন ।
হুট করে নাঈম বলে উঠলো , " ক তো মানুষ এহন আমগো দেখলে কি কইবো ? হাতে ব্যাট দেইখা ক্রিকেটার কইবো ? নাকি মাথায় হ্যাট দেইখা টুরিস্ট কইবো ? হাতে বাজারের ব্যাগ দেইখা স্থানীয় কইবো? না ডেকচি দেইখা তাবলীগ জামাত কইবো ? " 😅
বাসা থেকে আনা শুটকি ভর্তা কিছুটা বেঁচে ছিল । দুপুরে চিড়া দিয়ে খেয়ে ফেললাম সেটুকু । হিমছড়ি বিচ পার করে চোখ আটকে গেল এক ঝাঁক লালে ।
" কাঁকড়া না ? "
" হ কাঁকড়াই তো ওডি!! "
" খাইছে রে , ল ল "
সারি সারি , শয়ে শয়ে লাল কাঁকড়া । কাছে যেতেই পুটুস করে গর্তে লুকিয়ে পরল সব ।
একটু এগোতেই দেখলাম প্যারাসেইলিং হচ্ছে , অনেক টাকা হলে একদিন করবো ইনশা আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগোলাম । দেখা হল আমাদেরই মতন এক হাইকারের সাথে । তিনি একাই টেকনাফ থেকে রওনা হয়েছেন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে , আজ তার দ্বিতীয় দিন । ইনশা আল্লাহ আজই পৌঁছে যাবেন কক্সবাজার ।
আর একটু এগোতেই পেলাম জেলেদের , জাল টেনে সৈকত থেকেই মাছ ধরছেন তারা । এমনকি কয়েকটা দলকে দেখলাম , কোথাওবা বাচ্চারা কয়েকজন মিলে ধরছে । একটা দলের জাল প্রায় উঠে এসেছে, উৎসুক মনে ছুটে গেলাম সেদিকে । হরেক কিসিম , হরেক রঙের মাছ । জেলেদের দেখলাম সামুদ্রিক বেলে মাছ ফেলে দিতে, আমরা চেয়ে নিয়ে নিলাম ওগুলো । মাছ গুলো কেটে লবন মরিচ দিয়ে মাখিয়ে রাখলাম । মাছ ধরা দেখতে দেখতেই সূর্য দিগন্ত রেখায় পৌঁছে গেল । দারুন ছিল ওই দিনের সূর্যাস্তটা। একদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, ঠিক বিপরীত দিকে পূর্ণ চাঁদ উঠছে, এক অপার্থিব দৃশ্য ।
পুরো বিকালটা কেটেছে জেলেদের সাথে, একটুও হাঁটা হয়নি । সূর্য ডুবতেই খেয়াল হলো এখনো বাকি প্রায় ৭০ কিলো পথ । একটানা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত হেঁটে তাবু খাটালাম সৈকতের সাথে এক ঝাউ বনের মধ্যে । ভুতুড়ে থমথমে পরিবেশ , সামনে সাগরের গর্জন । ঝাউ পাতার ফাক দিয়ে দেখা যাচ্ছে পুর্ণ চাঁদটা । পিয়াজ মরিচ দিয়ে মুড়ি খেয়ে শীতে জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়লাম তিনজন ।
১৯ ডিসেম্বর , ২০২১। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখ আটকে গেল সাগরের দিকে। ঝাউ বনের ঠিক সামনেই সাগর। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে সাগরটা । থমথমে, নিশ্চুপ। নাঈম বেরিয়ে পড়েছে , সাগরের দিকে যাচ্ছে , ফিরে এলো উত্তেজিত হয়ে । মাথার খুলির মতন কিছু একটা পেয়েছে ও । দেখে অনুমান করলাম হবে হয়তো কোন মাছের । পরে বুঝতে পারলাম ওটা খুব সম্ভবত ডলফিন এর খুলি ।
ঝাউবনে ফিরে শুকনো খড়ি জোগাড় করে ধরালাম আগুন , কালকের মাছগুলো ভেজে নিলাম । মুড়ি দিয়ে মাছ ভাজা খেয়ে আবার শুরু করলাম হাঁটা । এখন পুরো সৈকত লাল কাঁকড়ায় ভরা , ঢেউয়ে ভেসে এসে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য শামুক-ঝিনুক, কত বিচিত্র রঙের । পথে একটা খাল পরলো , রাস্তায় উঠতে হলো আমাদের । প্রবেশ করলাম টেকনাফ উপজেলায় । রাস্তার পাশেই একটা বাড়িতে দেখলাম সামুদ্রিক মাছ শুটকি দেয়া , এক কোনার তিনটা মাছের দিকে চোখ আটকে গেল ।
" হাঙ্গর না ? "
" হ, হাঙ্গরই তো !! "
তিনটা হাঙ্গরের বাচ্চার শুটকি !
আবার সৈকতে নামলাম আমরা । পার হলাম জেলেদের পাড়া , মোনাখালী সৈকত , সারি সারি সাজানো নৌকা , শত শত , হাজার হাজার লাল কাঁকড়া । দেখতে দেখতে এই সূর্যটাও অস্ত গেল । এখনো অনেকটা পথ বাকি । পায়ের অবস্থা ভালো না । তবে জোৎস্না সাথে, ডানে সাগরের গর্জন আর বামে পাহাড় নিয়ে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না হাঁটতে । অদ্ভুত লাগছিল বামের পাহাড় গুলোকে , এক স্থানে মনে হচ্ছিল যেন শুয়ে আছে কোন এক যুবতী । ঝিরিঝিরি বাতাসের মধ্য দিয়ে হাঁটছি , মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময় পর পর আসছে একেকটা মাইলফলক । একেকটা মাইলফলককে মনে হচ্ছিল একেকটা প্রাপ্তি । মাইলফলকের আসল অর্থটা বুঝে আসছিল তখন। রাত দেড়টা পর্যন্ত একটানা হেঁটে টেকনাফ বিচের ২ কিলো আগে তাবু খাটালাম এক ঝাউবনে । দূরে মিটমিট করছে জেলেদের নৌকার লাল-নীল-সবুজ আলো । এখনো ১৪ কিলো বাকি শাহপরীর দ্বীপ , কাল সকাল দশটার মধ্যে যেতে হবে। রাতে আর দেরি না করে দিলাম এক ঘুম।
২০ ডিসেম্বর , ২০২১। বাংলা চ্যানেল সাঁতারের দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডানে বামে না তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলাম কিছু মুখে না দিয়েই । নাঈম ব্যাগ থেকে বের করলো লাল সবুজের পতাকাটা , বেঁধে নিল পিঠে । কুয়াশার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলো সূর্য । আবহাওয়াটা একটু শীতল আজ , এর মধ্যেও ঘাম গড়িয়ে পরছে ঘাড় বেয়ে । পায়ের অবস্থা ভালো না , তবু থামার উপায় নেই । অনেকেই পিছু নিচ্ছে আমাদের , একটা বাচ্চা তো কয়েক কিলো হাঁটলো আমাদের সাথে ।
৯ টা ১৭ , আমরা তখন শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম বীচের পাশে । এখনো প্রায় ৩-৩.৫ কিলো শাহপরীর দ্বীপের জেটি । হাঁপাচ্ছি আমরা , দেখতে পারবো তো সাঁতারের শুরুটা ? তখনই কেমন যেনো একটা জটলা চোখে পরলো বীচে । এক ছোকরা এসে জানালো এখান থেকেই এবার হচ্ছে বাংলা চ্যানেল সাঁতারের শুরু । বসে পড়লাম গা ছেড়ে দিয়ে , কি যে আনন্দ লাগছিলো । আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আর কিছুই না , আমরা থেমেছিলাম এখানে , জেটিতে চলে যাইনি । তাহলে দেখতে পারতাম কিনা সাঁতারের শুরুটা আল্লাহই জানে।
সাগরটা আজ অশান্ত , বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। কিছুক্ষন পরই শুরু হলো সাঁতার , অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় ৮০ জন অকুতোভয় সাতারুকে ছোট হতে হতে মিলিয়ে যেতে । তারা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার পরও তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষন । অংশগ্রহণ করতে না পারার কষ্টটা আরো গভীরভাবে আঘাত করলো তখন ।
শাহপরীর দ্বীপ থেকে চলে এলাম টেকনাফ । টেকনাফ থেকে পাওয়া যাবে সেন্টমার্টিনের লোকাল ট্রলারগুলো । আজ আর কোনো ট্রলার না থাকায় কালকের জন্য অপেক্ষা করতে হলো । রাতটা কাটিয়ে দিলাম টেকনাফের এক মসজিদে।
ওস্তাদিয়া চলবে....