22/12/2022
ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় শহরে পৌঁছে পর দিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম শহর থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘হা লং বে’ বা হা লং উপসাগরের পথে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিরিখে যে অঞ্চলটির খ্যাতি জগৎজোড়া, যার অপরিসীম সৌন্দর্যের টানে প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকরা ছুটে আসেন।
১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো হা লং উপসাগরকে ‘ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে। শহর থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। যেতে যেতে গাইড জানান, এই উপসাগরে প্রায় দু’হাজারের মতো এক শিলাবিশিষ্ট স্তম্ভ ছড়িয়ে আছে, যেগুলির অধিকাংশই জনবসতিহীন। সামান্য যে ক’টিতে জনবসতি আছে, তাদের বেশির ভাগই মৎস্যজীবী।
বাস থেকে নামতেই সামনে পড়ল মুক্তোর অলঙ্কার বিপণি। যেমন বড়, তেমনই ঝাঁ চকচকে। স্থানীয় মহিলারা উপসাগর থেকে সংগ্রহ করে আনা জীবন্ত ঝিনুক থেকে মুক্তো বার করে কী ভাবে অলঙ্কার তৈরি করেন, তা দেখানো হল। পর্যটকরাও এখান থেকে মুক্তোর গয়না কিনতে পারেন। বিপণি দেখে সোজা চলে আসি ফেরিঘাটে। সেখানে পর্যটকদের প্রমোদভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান সারি সারি লঞ্চ।
গাইডের নির্দেশমতো উঠে পড়ি একটায়। ভিতরে ঢুকতেই ‘ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস’ দিয়ে অভ্যর্থনা জানান এক তরুণী। সুন্দর আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। পর্যটকরা যাতে হা লং বে’র সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি খাওয়াদাওয়াও সারতে পারেন, সে জন্য প্রত্যেকের সামনেই সুদৃশ্য ডাইনিং টেবল পাতা। খানিক বাদেই এল ভাত, স্যালাড, তরকারি, দু’রকম সামুদ্রিক মাছ, চিকেন কষা, চাটনি, পাঁপড় ও ফল।
আমরাও ততক্ষণে উপসাগরের রূপে মুগ্ধ। উপসাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে দেখি উপসাগর জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় বড় পাথরের চাঁই। এগুলির কয়েকটি বৃক্ষহীন হলেও, বেশির ভাগ পাথরস্তম্ভের গায়েই সবুজের ছড়াছড়ি। আপনমনে পাখিদের আনাগোনা দেখতে দেখতে স্তম্ভগুলির পাশ দিয়ে এগোতে থাকি। চোখের সামনে তখন দেশবিদেশের পর্যটক-বোঝাই লঞ্চ ভেসে চলেছে উপসাগর জুড়ে।
খানিক দূরে রং-বেরঙের ছোট ছোট রবারের নৌকা নিয়ে একদল পর্যটক মেতে উঠেছেন ‘কায়াকিং’-এ। আমরা কায়াকিং-এ আগ্রহী না হওয়ায় লঞ্চ চলল এগিয়ে। খানিকক্ষণ চলার পরে এসে থামল একটা বড় দ্বীপের সামনে। এখানেই রয়েছে একটি বিখ্যাত চুনাপাথরের গুহা। সেটি এত বড় যে, একসঙ্গে এক হাজার পর্যটকও দাঁড়াতে পারেন অনায়াসে।
শুনলাম, ১৯০১ সালে ভিয়েতনাম যখন ফরাসিদের অধিকারে, সে সময়ে তারাই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই গুহাটি আবিষ্কার করে নাম দেয় ‘সারপ্রাইজ় কেভ’। সাং সট কেভ নামেও এটি পরিচিত। যদিও হা লং উপসাগরের এক প্রান্তে অবস্থিত এই গুহাটিকে সাজিয়েগুছিয়ে দর্শনের উপযোগী করে পর্যটকদের দেখার জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৯৩ সালে। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকি আমরাও। প্রায় তিরিশ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট এই গুহাটির চারপাশে অপরূপ ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। দেখে মনে হয় যেন রামকিঙ্কর বেজের মতো কোনও শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে শিল্পকর্মগুলি। ঝাড়বাতির মতো আকৃতি নিয়ে কোনওটি নেমে এসেছে উপর থেকে, কোনওটি বা নীচ থেকে বেড়ে উঠেছে উপরের দিকে অপরূপ কারুকার্যে শোভিত হয়ে।
বেশ কিছুক্ষণ গুহাটির ভিতরে সময় কাটিয়ে বেরিয়ে আসি বাইরে। যে দিকে তাকাই, সে দিকেই চোখে পড়ে উপসাগরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা অনুচ্চ পাথরের সারি। বিশ্বের একপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অপরূপ সৌন্দর্য ভাণ্ডারের দিকে অপলকে চেয়ে থাকি। চমক ভাঙে গাইডের ডাকে। জানায়, এ বার ফিরতে হবে।
একরাশ তৃপ্তি নিয়ে উঠে আসি লঞ্চে। অস্তগামী সূর্যের শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে পড়েছে হা-লং বে’র জলে, পাথরচূড়ার মাথায় মাথায়। আকাশটাও যেন জীবনানন্দ দাশের কথায় ‘ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।’
লঞ্চ ছাড়ে। জল থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরগুলির পাশ দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ শুনি ডেকের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার এক সহযাত্রী-বন্ধু আপনমনে গাইছেন— ‘মধুর, তোমার শেষ যে না পাই…’