24/09/2022
হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনী (রহ.) এর ৩৬০ জন সফরসঙ্গীর অন্যতম হযরত দাউদ শাহ কোরেশী (রহ.) এর মাজার শরীফ,
সুগন্ধীয়া, ঝালকাঠী সদর, ঝালকাঠী ।
বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের আদিপর্বে যে সকল মহাপুরুষদের আগমন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো হযরত দাউদ শাহ কোরেশী রহমতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম।
ইতিহাস থেকে জানা যায় সিলেটে শায়িত হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি এর এদেশে হিজরত করার ক্ষেত্রে যে ৩৬০ জন সফরসঙ্গী ছিল তন্মধ্যে হযরত দাউদ শাহ কোরেশী রহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম।
তবে কারো কারো মতে, হযরত দাউদ শাহ্ কোরেশী (রহ.) সম্রাট শাহ সুজার আমলে ঝালকাঠিতে এসেছিলেন বলে অনুমান করা হয়।
তবে ঐতিহাসিক সিরাজ উদ্দীন আহমেদ বলেন, হযরত দাউদ শাহ কোন সময় চন্দ্রদ্বীপে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসেন তা নিয়ে মতান্তর আছে। কেউ বলেন তিনি সুলতানী আমলে সুদূর ইরান থেকে এসে খড়ম পায়ে সুগন্ধা নদী অতিক্রম করে এ অঞ্চলে আগমন করেন। আবার কেউ বলেন তিনি মোগল আমলে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কাহিনী ও মসজিদের নির্মাণ কৌশল দেখে মনে হয় হজরত দাউদ শাহ মোগল আমলে প্রথম দিকে বাকলায় আগমন করেন। সুগন্ধিয়ায় সরদারদের পূর্বপুরুষ শ্রাবণ ঠাকুর দাউদ শাহের সমকালীন। সরদারের বংশতালিকা অনুসারে দেখা যায় দাউদ শাহ্ ১৬ শতকের শেষভাগে এ অঞ্চলে আসেন।
জনশ্রুতি আছে তিনি একজন শ্রমিকের ছদ্মবেশে শ্রাবণ ঠাকুরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। একদিন শ্রাবণ ঠাকুরের স্ত্রী দেখতে পেলেন দাউদ শাহের হাতের ইশারায় নারিকেল গাছ নিচু হয়ে যায় এবং তিনি সে গাছ থেকে দাঁড়িয়ে নারিকেল পাড়েন। আর একদিন দেখা গেল দাউদ শাহ্ চুলায় কোন কাঠ না দিয়ে তার নিজের পা জ্বালিয়ে ধান সিদ্ধ করছেন। এঘটনা দেখে শ্রাবণ ঠাকুর ও তার স্ত্রী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর নাম হয় শ্রাবণ খাঁ। তারপর দাউদ শাহ শ্রাবণ খাঁ কর্তৃক নির্মিত খানকায়ে খোদার ধ্যানে মগ্ন হলেন। তিনি একদিন তাঁর ভক্তদের বললেন, তিনি কবরের মধ্যে তিন দিন ধ্যানে মগ্ন থাকবেন এবং এ সময় তাকে যেন ওঠানো না হয়। কিন্তু ভক্তগণ বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারলনে না। তারা কবরখোঁড়া শুরু করল। কবরে শব্দ শোনাগেল। দেখা গেল কবরে একচাপ রক্ত পড়ে আছে। ভক্তগণ রক্ত কবর দিলেন। সেই রক্তের উপরের কবরই হযরত দাউদ শাহ কোরেশী (রহ.) মাজার মাজার শরীফ।
এছাড়াও কথিত আছে গৌড়ের শাসনকর্তা হযরত দাউদ শাহ রহ. এর সাধনার কথা শুনে মুগ্ধ হন। তিনি রাজমহল ও রাজস্থান থেকে সাদা পাথর এনে মাজার নির্মাণ করেন। মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু সাদা পাথর এবং কবরের মেঝে কালো পাথর দিয়ে বাঁধানো। দাউদ শাহের কবরের উপরে কালো পাথরে কোরানের বাণী যত বড় আকারে উৎকীর্ণ আছে, বাংলাদেশে অন্য কোনো মাজারে কোরানের বাণী এতবড় আকারে উৎকীর্ণ নেই। সামনে তার খাদেম মতান্তরে সর্দার বংশধর আলামত খাঁ ও নেয়ামত খাঁর কবর আছে। মাজারে দুই খন্ড পাথর আছে। প্রবাদ আছে পাথরগুলো এখানে ভেসে এসেছে। মাজারের সামনে মসজিদ আছে। পাশেই একটি দীঘি।
মাজারের তত্ত্বাবধানের জন্য মোগল সম্রাট লাখেরাজ সম্পত্তি প্রদান করেন। চেরাগী দাউদ শাহ (কিসমত চরামদ্দি, পরগণা চন্দ্রদ্বীপ) নামে লাখেরাজ সম্পত্তি ছিল। শ্রাবণ খার পুত্র আলামত খার পুত্র আহম্মদ খার নামে এই লাখেরাজ সম্পত্তি ছিল। আহম্মদের নামে চর আহম্মদিয়া বা চরামদ্দির নাম হয়েছিল। ইংরেজ সরকার এ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়।ইতিহাস থেকে জানা যায়, সরদার দের নিকট ফার্সী ভাষায় লেখা দু’খানা দলিল আছে।
আর এই স্থানীয় সরদার বংশ তথা যাদের পূর্বপুরুষ ছিল শ্রাবণ ঠাকুর তথা শ্রাবণ খাঁ, তারা মাজারের তত্ত্বাবধায়ক তথা খাদেম হিসেবে ছিল।বর্তমানে অবশ্য সরদার পরিবার নয়, বরং খন্দকার পরিবার মাজারের খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে।
তথ্যসূত্র অনুযায়ী হযরত দাউদ শাহ্ কোরেশী (রহ.) কর্তৃক এতদঞ্চলে তিন খানা মসজিদ নির্মাণ করার হয় বলে নজির পাওয়া যায়। ঝালকাঠি বন্দরে একখানি মসজিদ স্থাপন করেছিলেন এবং সেখানে বসে দ্বীনের দাওয়াতের জন্য মানুষদেরকে আহবান জানাতেন। ঝালকাঠির তাবলীগ মসজিদের ঠিক কাছেই তিনি এই পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন। একটি ছোট্ট পাকা খুপরির মত নামাযের ঘর রূপে এই মসজিদ ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে। পরবর্তীতে সেই জীর্ণ ঘরটি ভেঙ্গে ঝালকাঠি মারকাজ মসজিদ নির্মিত হয়েছে।
এ ছাড়া হযরত দাউদ শাহ্ ঝালকাঠির শহরতলীর সুতালরীতে ও নলছিটিতে মসজিদ নির্মাণ করেছেন।
ঝালকাঠী সদরের সুগন্ধিয়ায় অবস্থিত হযরত দাউদ শাহ্ কোরশী (রহ.) এর মাজারের পশ্চিম দক্ষিণ প্রান্তের কয়েকটি ভগ্ন কবর তাঁর সাথীদের বলে অনুমিত। হয়তো দাউদ শাহ্ (রহ.) দরবার ছিল এটা।
দার্শনিক হযরত কায়েদ সাহেব হুজুর (রহ.) বহুবার এ মাজারে এসে নির্ধারিত তারিখে ওয়াজ মাহফিল করে মাজার সংশ্লিষ্ট আচার-আচরণকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর ধারায় পরিবর্তন করেন।
সংগ্রহেঃ বদরুল আলম সাইফী