03/07/2016
বাঙালি জাতির নিপীড়ণ গাঁথা: ২৩ নভেম্বর ও ৭ মার্চ নিপীড়ণ দিবসের কথামালা
নূর মোহাম্মদ কাজী
প্রতিটি জাতির জীবনে যেমন থাকে গৌরবের স্মৃতি-গাঁথা, তেমনি থাকে দুঃখ-বেদনা ও নিপীড়ণের স্মৃতি-গাঁথা। স্বস্বজাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এ দু’টি স্মৃতি-গাঁথা নির্মিত হয়। এ স্মৃতি-গাঁথা গ্রন্থনা করেন দেশের জ্ঞানী-গুণী, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মি ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ। বাঙালি জাতির জীবনেও যেমন রয়েছে গৌরবের স্মৃতি-গাঁথা (Narratives of Pride), তেমনি রয়েছে দুঃখ-বেদনা ও নিপীড়ণের স্মৃতি-গাঁথা (Narratives of oppression)। আমাদেরে দুঃখ-বেদনা ও নিপীড়্ণ স্মৃতি-গাঁথার প্রধান গ্রন্থনাকারী হলেন মহান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরের মহাসাইক্লোনের পর ২৩শে নভেম্বর ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের বিশাল জনভায় দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম বাঙালি জাতির দুঃখ-বেদনা ও নিপীড়ণ স্মৃতি-গাঁথা বর্ণনা করেন এবং নিজ কন্ঠে শ্লোগান দেন “স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান”। জনসমুদ্র থেকে সোচ্চার প্রতিধবনি উঠে “জিন্দাবাদ”। এ স্মৃতি-গাঁথার ধারাবাহিকতায় বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স যে ভাষন দেন তাতে তিনি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ণের বর্ণনা দেন। এ ভাষনে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। এভাবে বাঙালি জাতির এ দু’মহান নেতা বাঙালি জাতির এ দুঃখ-বেদনা ও নিপীড়ন গাঁথাকে প্রতিরোধ শক্তিতে পরিনত করেছিলেন।
এ স্মৃতি-গাঁথার প্রেক্ষাপট কিভাবে তৈরী হলো? উল্লেখ্য, বাঙালি মুসলমানরা হিন্দিবলয়ভুক্ত উত্তর ভারতের মুসলমানদের সাথে ১৯৪৭ সালে একত্রিত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। আশা ছিল এ মুসলমানরা বর্নবাদ বিরোধী লড়াইয়ে বাঙালি মুসলমানের সাথে থাকবে। দুঃখের বিষয় এই যে, ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও হিন্দিবলয় থেকে বাংলাদেশে আগত বিহারী-গুজরাটি মুসলমান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী ও বালুচরা বাঙালি মুসলমানদের সাথে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ে সামিল হন নাই। বরং কৃষ্টি-কালচারের মিল থাকায় তারা উত্তর ভারতের হিন্দিবলয় ভুক্তই থেকে গেছেন। এ কারনে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী ২৩ বছরেও বাঙালিদের সাথে এক হতে পারেনি।
২৩শে নভেম্বর নিপীড়ন স্মৃতি-গাঁথা দিবস
বাঙালি মুসলমানদেরর সাথে হিন্দি বলয়ভুক্ত মুসলমানদের মানসিক ঐক্য কখনো গড়ে উঠেনি। এবং এ বিষয়টি সর্বশেষ ফুটে উঠেছিল ১৯৭০ সালে ঘটে যাওয়া বঙ্গোপসাগরের মহাসাইক্লোনের পর। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর মহাসাইক্লোনে দক্ষিন বাংলার ১০ থেকে ১২ লক্ষ অসহায় মানুষ বঙ্গোপসাগরে ভেসে গিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার এ ভয়াবহ ঘটনায় তাত্ক্ষনিকভাবে কোন ব্যবস্থাই গ্রহন করে নাই। এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক নেতা বাঙালি জাতির এ দুর্দিনে পুর্ব পাকিস্তানে আগমন করেনি। এমন কি একটি বিবৃতি দিয়েও সহানুভূতি জানায় নি। এর দু’দিন পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা হয়ে দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ার দেশগুলু সফরে যান। তিনিও এত বড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বে নেবার প্রয়োজন মনে করেন নি। এ বিষয়টি মহান নেতা মওলানা ভাসানীকে যার পর নাই ব্যথিত করে তুলেছিল।
১২ই নভেম্বর মহাসাইক্লোনের দিন যখন দক্ষিন বাংলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায় তখন মওলানা ভাসানী গুরুতর অসুস্থ। তিনি ঢাকায় একটি হাস্পাতালে ভর্তি অবস্থায় ছিলেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বমি হওয়ার দরুণ হুজুর সিয়াম পালন করতে পারছিলেন না। তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, দলের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে বিবৃতি প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু ১৪ নভেম্বর রাত্রিতে মহাসাইক্লোনের খবর তাকে জানালো হলো। তিনি ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ডাক্তারদের সকল প্রকার বাধানিষেধ উপেক্ষা করে বিপর্যস্ত এলাকা সফরের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৬ই নভেম্বর তিনি বিপর্যস্ত এলাকা সফরের উদ্দেশে রওনা দেন।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ বিভাগের ছাত্র। আমাদের বিভাগের ৭ জনের একটি টিম গঠন করে আমরা রেড-ক্রসের উদ্যেগে আয়োজিত উদ্ধার কাজে ১৪ই নভেম্বর হাতিয়ায় পৌছে ছিলাম। ১৮ই নভেম্বর আমরা সকাল ১০/১১টার সময় হাতিয়ার বড় রাস্তার লাগোয়া গ্রামে উদ্ধার কাজ করছিলাম। এমন সময় খবর পেলাম মওলানা ভাসানী হুজুর হাতিয়ায় এসেছেন এবং রিক্সায় বড় রাস্তা ধরে যাচ্ছেন। আমরা ছুটে গেলাম হুজুরের কাছে। পা ছুয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে রিক্সা থেকে নামলেন। আমরা তাঁকে রাস্তার পাশে জনপ্রানহীণ বিপর্যস্ত একটি বাড়িতে নিয়ে গেলাম। এ বাড়ির তিনটি গৃহস্থের ১৩ জন সদস্যের সকলকেই মহাসাইক্লোনে নিখোঁজ হয়ে গেছে। সাগরে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। হুজুর হাত তুলে এখানে সকলের জন্য দোয়া করলেন। তিনি বেশীক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। আমার কাঁধে হাত রেখেই তিনি এগিয়ে গিয়ে রিক্সায় গিয়ে উঠলেন এবং হাতিয়ার চরের দক্ষিনের দিকে চলে গেলেন।
আমাদের রাত্রিবাসের জন্য নির্ধারিত ছিল হাতিয়ায় অবস্থিত একটি ডাকবাংলা। রাতে ফিরে দেখি লন্ডন থেকে মওলানা ভাসানীর এক ভক্ত বিখ্যাত প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী তারিক আলী এসেছেন দুর্গত এলাকা সফর করতে। হাতিয়ায় তিনি হুজুরের সাথে দেখা করেছেন। রাতে ডাকবাংলায় তার সাথে আমাদের সাথে আলাপ হয়। তিনি বললেন, “মহাসাইক্লোনে যারা মারা গেছে তারা তো চলে গেছে, আর যারা বেঁচে আছে এখন তারা মারা যাবে না খেয়ে। অথচ হাতিয়ার গোডাউনে এ এলাকার মানুষের তিন মাসের খাবার মওজুদ রয়েছে”। তার সাথে আলাপের পর আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে ডাকবাংলার আশে পাশে জড়ো হওয়া মানুষের চিত্কার শুনে। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম হাতিয়ার ভুখা মানুষরা ডাক বাংলার পাশে অবস্থিত গোডাউন থেকে চালের বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। পরে শুনেছি তারেক আলী সাহেব গোডাউনের তালা খুলে দিয়েছেন এবং ভুখা মানুষদের চালের বস্তা নিয়ে যেতে বলেছেন।
আমরা এক সপ্তাহ পরে ঢাকায় ফিরেছিলাম। শুনতে পেলাম মওলানা ভাসানী হুজুর উপকূল এলাকা সফর শেষে ঢাকায় ফিরেছেন। সপ্তাহ খানেক তিনি উপকূল এলাকায় ছিলেন। মাইলের পর মাইল রিক্সায় ও পায়ে হেটে বিপর্যস্ত মানুষের খোঁজ খবর নিয়েছেন। ২৩শে নভেম্বর হুজুর পল্টনের জনসভায় ভাষণ দেবেন। আমরা ছুটে গেলাম পল্টন ময়দানে। তিনি এ সভায় মহাসাইক্লোনে ১০ থেকে ১২ লক্ষ বাঙালি সন্তানের বঙ্গোপসাগরে ভেসে যাবার করুন কাহিনী বর্ননা করেন। হাতিয়ায় নিজের স্ব-চোক্ষে দেখা অভিজ্ঞতা এবং মওলানা ভাসানীর বর্ণনা শুনে বার বার আমার ঢুকরে কান্না আসছিল। হুজুর বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেনঃ
হযরত নূহের জামানার পর এতোবড় প্রলয়কান্ড মানুষের ইতিহাসে ঘটে নাই। পূর্ব বাংলার উপকূলের ১০ থেকে ১২ লক্ষ নর-নারী ও শিশু এই দুর্্যোাগে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু মহাধবংসযজ্ঞের ১০ দিন পরও প্রায় ৪ লক্ষ লাশ পড়ে আছে। এদের দাপনের কোন ব্যবস্থা নেই। গলিত লাশ ও মরা পশুর দুর্গন্ধের মধ্যে যারা এখনো আর্তনাদ করছে, আল্লাহর কুদরতে তারা বেঁচে আছে। ... আমাদের লক্ষ লক্ষ ভাইবোনদের মৃত্যুর সংবাদ রেডিও পাকিস্তান ও সরকার আমাদের জানায় নি। আট হাজার মাইল দূর থেকে বিবিসি মারফত আমরা এই দুঃসহ সংবাদ জানতে পেরেছি। এ ছাড়া দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে সাংবাদিক ও আলোকচিত্র শিল্পীরা এগিয়ে আসলেও আমাদের ইসলামাবাদের সরকার দুর্গত বাঙালিদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ...অথচ কথায় কথায় জাতীয় সংহতি ও ভ্রাতিত্বের কথা বলা হয়ে থাকে। এই সব সংহতি ও ভ্রাতৃত্ব বোগাস।
দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ নভেম্বর, ১৯৭০।
দৈনিক পাকিস্তান আরো লিখেছে, এক পর্যায়ে মওলানা ভাসানী নিজ কন্ঠে শ্লোগান দেন “স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান”- জনসমুদ্র থেকে সোচ্চার প্রতিধবনি উঠে “জিন্দাবাদ”। পল্টনের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে হুজুরের এই ভাষণ শুনে আমাদেরে প্রিয় কবি শামসুর রহমান তাত্ক্ষনিকভাবে লিখেন তার বিখ্যাত ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতাটি। স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেই কবি লিখেছেন, “হায়! আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী”। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-গাঁথার এ এক অমর কবিতা।
এ প্রেক্ষাপটে আমরা ২৩ শে নভেম্ববরকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-গাঁথা দিবস হিসেবে ঘোষনা করেছি। কারন, এ দিনই মুলতঃ মহান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের সাথে বাঙালি জাতির সামাজিক সম্পর্ক (Social Contract) ত্যাগের স্পষ্ট ঘোষণা দেন। এ দিনই তিনি বাঙালি জাতির প্রতি বহিরাগত শাসকদের শোষণ ও নির্দয়তার সূস্পষ্ট বয়ান (Narratives of oppression) দেন এবং জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্নকে স্পষ্ট করে তোলেন।
নিপীড়ণ গাঁথা ও মওলানা ভাসানী
আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর এডভোকেট মুজিবুর রহমান মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর একজন ভক্ত-অনুসারী ও রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তিনি মওলানা ভাসানী জীবিতকালে ভাসানী-ন্যাপের ঢাকা মহানগরী শাখার সভাপতি ও পরে কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফারাক্কা ইস্যু জাতি সংঘসহ বিভিন্ন আন্রর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরার জন্য তিনি আমাকে চীন ও আমেরিকা গমনের সকল প্রকার সহযোগীতা করেছিছেন।১৯৯৩ সালের শেষের দিকে আমেরিকায় আসার পর তিনি লোক মারফত আমাকে একটি চিটি লিখে ছিলেন। কয়েকটি লাইনের এ চিঠিতে তিনি আমার কাজের অগ্রগতি জানতে চেইয়েছিলেন এবং তার স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতির কথা উল্লেখ করার পর লিখেছেন “আমাকে এসে হয় তো বা আর পাবে না। তোমার প্রতি আমার অনুরোধ রইলো, মওলানা ভাসানীর আদর্শ অনুসরনের চেষ্টা করো। তিনি আমাদের মহান জাতীয় নেতা, ভবিষ্যত দ্রষ্টা ও রাষ্ট্র গুরু। তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের বেকন (রাতে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের পথ নির্দেশনার জন্য তীরে স্থাপিত আলোক স্তম্ব)”। মওলানা ভাসানীর প্রতি আমার শ্বশুরের গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তিনি তাঁকে পিতার মত শ্রদ্ধা করতেন। এ চিঠি লেখার কিছু দিন পর ১৯৯৪ সালের ২৮শে জানুয়ারী তিনি ইন্তেকাল করেন। তার এ সর্বশেষ লেখা চিঠি আজো আমি রক্ষা করছি। মওলানা ভাসানীর আদর্শ অনুসরন করতে কেন আমার শ্বশুর উপদেশ দিয়ে গেলেন তা আমার জীবনে এক বড় প্রশ্ন হয়ে আছে। আজ এ লেখায় আমি তা বিশ্লেষন করতে চাই।
পৃথিবীর সকল দেশের সকল জাতির মধ্যেই স্বপ্ন দ্রষ্ঠা (Dreamer), ভবিষ্যত দ্রষ্টা (Visionary) ও রাষ্ট্র নায়ক (Statesman)থাকেন ও মহান জাতীয় নেতা (Great National Leader)থাকেন। স্বপ্ন দ্রষ্টাগন স্বপ্ন দেখান। ভবিষ্যত দ্রষ্টা জাতিকে আগামি দিনের মুক্তির দিশা দেখান। আর রাষ্ট্র নায়কগন সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে জাতির আশা আকাংখা পুরন করেন। আর মহান জাতীয় নেতা (Great National Leader) সমসাময়িক জাতীয় ইস্যুগুলুকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে জাতীয় মুক্তি অর্জনে গুরুর ভুমিকা পালন করেন এবং জাতির জন্য আগামী দিনের দিক নির্দেশনা রেখে যান। অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে দেন। এ চার ধরনের মহান ব্যাক্তিত্ত্বের মধ্যে রয়েছেন চীনের মাওসেতুং ও চৌ এন লাই, রাশিয়ার লেনিন ও স্তালিন, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিংকন, ফ্রান্সের চার্লস ড্য গল, বৃটেনের উইন্স্টন চার্চিল, কানাডার পিয়ের ট্রুডো, জাপানের হিরোহিতো, ভারতের মহাত্মা গান্ধি ও মহামতি ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনী, কিউবার ফিডেল কাস্ট্রো, ল্যাটিন আমেরিকার চে গুয়েভারা মহান আফ্রিকার নেলশন মান্ডেলা। তবে এদের অনেকেই একাধারে স্বপ্ন দ্রষ্টা, ভবিষ্যত দ্রষ্টা ও রাষ্ট্র নায়ক ছিলেন। আমাদের দেশের স্বপ্ন দ্রষ্টা হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, ভবিষ্যত দ্রষ্টা মহান নেতা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আর মহান রাষ্ট্র নায়ক ছিলেন বংগ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আমরা এখানে আমরা আমাদের মহান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী সম্পর্কে বলব।
তরুন বয়সেই মওলানা ভাসানী বুঝে ছিলেন স্বাধীনতার চাইতে বড় সম্পদ মানুষের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। স্বাধীন মানুষই পারে সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার মানুষের সব চাইতে আগে দরকার স্বাধীনতা। তারা মুক্তি চায়। মুক্তির জন্য তাদের আকুতির সীমা নাই। তারা কথায় কথায় স্বাধীনতার গান রচনা করে। যারা অধীন করে রাখতে চায় তাদের প্রতি তাদের ক্ষোভের সীমা নাই। তাদের মুক্তির গানে আধিপত্যকামীদের প্রতি বিদ্রোহের সুর সদা ঝংকৃত হয়। তাদের সুর অসুরের বিরুদ্ধে। জাগতিক মুক্তির চেতনাকে তারা অধ্যাত্ববাদের সাথে মিশিয়ে এক করে দেখেন। মওলানা ভাসানী তাই এ মানুষগুলুর জন্য এক আধ্যাত্ত্বিক জাতীয়বাদের সোপান নির্মান করেন। স্বাধীন মনের মানুষের সন্ধানে তিনি আসামের গহীন জংগলের আধ্যাত্ত্বিক পীর নাছির উদ্দিন বোগদাদীর দরবারে গিয়ে হাজির হন। এ পীরের সান্নিধ্যে এসে তিনি কঠোর সাধনা বলে কামিলিয়াত অর্জন করেন। জীবনভর কঠোর পরিশ্রম করে তিনি আসাম-বাংলার বিস্তৃর্ন জনপদ ঘুরে স্বাধীন চেতনার মানুষ তৈরী করেন। তারা তাঁর অনুসারী-মুরিদ।
এ সময় তিনি বাংলার নিপীড়িত মানুষের দু।খ মোচনের জন্য সি আর দাস-সুভাস বোসের নেতৃত্ত্বে গড়ে উঠা বাংগালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দিলেন। সি আর দাসের বেংগল প্যাক্ট ছিল এ অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের মহামূল্যবান দলিল। মওলানা ভাসানী এ প্যাক্ট কার্যকর করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করেছেন। এ দলিলের শর্তগুলু বাংগালি মুসলমান মানলে কি হবে হিন্দু বাংগালি এবং বাংলার জমিদার শ্রেনী মানল না। কতিপয় জমিদারের জমিদারীর জন্য সে যে ঐক্য ভাংগন ধরলো যা আর জোড়া লাগলো না। বাংলার মুসলমানদের জন্য শেরে বাংলা পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখলেন। তাই তিনি ১৯৪০ সালে মূসলিম লীগের লাহোর কনফারেন্সে ঘোষনা করলেন ভারতের পুর্বাঞ্চলের বাংলাদেশ এবং যে সব রাজ্যে মুসলমানের সংখা বেশী সেসব এলাকাগুলুতে পৃথক পৃথক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রসমুহ গঠিত হবে। এ ঘোষনার পর উত্তর ভারতীয় চক্রান্তকারীরা শেরে বাংলাকে বাংলার রাজনীতি থেকে কোন ঠাসা করে ফেলে। এ অবস্থায় আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি থাকা স্বত্ত্বেও মওলানা ভাসানই ১৯৪৭ সালে পুর্ব পাকিস্তান অর্জনে বিরাট ভুমিকা পালন করেন। তিনি সিলেট জেলাকে গনভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্গত করার লক্ষ্যে বিরাট অবদান রাখেন। মওলানা ভাসানী তার জীবনের এক বিরাট অংশ আসামে কাটান। এ জন্য আসাম-বাংলার মিলনের তিনি ছিলেন অগ্রদুত। প্রাকৃতিক ভাবে আসাম-বাংলার রূপ এক। এ জনপদের গনমানুষের আচার আচরন প্রাকৃতিক ভাবে এক। এটা লক্ষ্য করেই বৃটিশ রাজ দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে এ দু’ অঞ্চলকে এক করতে চেয়েছিলেন। তাও বর্ন হিন্দুদের বাধার কারনে হয়ে উঠেনি। এসব কারনে স্যার সলিমুল্লাহ ও শেরে বাংলার মনো কষ্টের কারন ভাসানীর চাইতে আর কে ভালো করে বুঝেছেন? এ সময় শুধু বাংলায় নয় আসাম ও সংখ্যা গরীষ্ঠ মুসলিম প্রদেশ ছিল। আসামে যাতে আর একটি মুসলিম রাষ্ট্রের দাবী না উঠে তাই মওলানা ভাসানী ও তার হাজার হজার অনুসারীদের বিতাড়নের যে রাজনীতি আসামে শূরু করা হয়েছিল, তার নাম ছিল “বাংগাল খেদাও আন্দোলন”। ভারত বিভাজনের পুর্বেই তারা ভাসানীকে গ্রেফতার করে এবং দশ লক্ষ্ বাংগালি মুসলমানকে আসাম থেকে বিতাড়ন করে। যারা আসামে জমি আবাদ করে সমৃদ্ধি এনেছিল তদেরকে এ ভাবে বিতাড়ন করায় বাংলা ও আসামের বিস্তৃর্ন এলাকায় সে সময় যে নীরব দুর্ভিক্ষ্যের সুচনা হয়েছিল, তার রেশ বহুদিন ধরে বাংলার মানুষকে সহ্য করতে হয়েছে। সে ভুমি হারানোর দুঃখ বাংলার মানুষ আজও ভুলতে পারে নাই।
মওলানা ভাসানী দশ লক্ষ অসহায় অনুসারী কৃষকদের নিয়ে স্বদেশভূমিতে ফিরে এ লেন যার নাম যার নয়া নাম পুর্ব পাকিস্তান। এসেই অনুভব করলেন স্বাধীনতার নামে পাকিস্তানী জমিদারের কবলে পড়েছেন। এ কারনে ১৯৪৯ সালেই তিনি গড়ে তুললেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। দাবী করলেন লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বশাসন চাই। এ স্বপ্ন শেরে বাংলার। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য রিলে রেসের লাঠি মওলানা ভাসানী তুলে নিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করলেন। তিনি বাংগালি মুসলমানের জাতীয়তাবাদ নির্মানের কাজ শুরু করলেন। ১৯৫২ সালে মওলানা ভাসানী ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ত্ব দেন। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের পাঁচটি জাতিস্বত্তাঃ বাংগালি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বেলুচ ও পাঠানের জন্য স্বায়ত্ত্ব শাসনের দাবীতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গড়ে তুললেন। পাকিস্তানের জমিদার শাসকগন প্রমাদ গুনলেন। বহুদিনের পুরানো সিন্ধীদের “জিয়ে সিন্ধ” জিন্দা হলো। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী হলো। ১৯৬৯ সালের গন অভ্যুত্থান সংগঠিত করে মওলানা ভাসানী স্বৈরাচারী আইউবের পতন ঘটান। প্রিয় অনুসারী শেখ মুজিবকে ফাঁসীর রজ্জু থেকে মুক্ত করে আনেন। মওলানা ভাসানী শেরে বাংলার স্বপ্নের রিলে রেসের লাঠি তাঁরই যোগ্য অনুসারী মুজিবের হাতে তুলে দেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তান ভিত্তিক নির্বাচন হলো। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেজোরিটি পেল। পাককিস্তানী সামরিক জান্তা শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা দিল না। মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সাল থেকেই ধাপে ধাপে স্বায়ত্ব শাসনের দাবীকে স্বাধীনতার দাবীতে উত্তীর্ন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৯ই জানুয়ারী সন্তোষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মৌলনীতি মালা ঘোষনা কর লেন। এ ঘোষনায় তিনি বললেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের কর্মসুচী সাম্য ও মুক্তির আদলে রচিত হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং সামাজিক ন্যায় বিচারে উদ্ভুদ্ধ হয়ে সাতকোটি পুর্ব পাকিস্তানী ইতিহাসের পাতায় সোনালী দিনের ঘোষনা দেবে। এদিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে বাংলার নিরীহ মানুষের উপর যাপিয়ে পড়ল। বীর বাংগালি অস্ত্রধরলো এবং ৯ মাস ব্যাপী এক রক্তক্ষয়ি গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম। কিন্তু এ স্বাধীনতার অনুসংগ হয়ে বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্য এলো। এর বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালের ২২শে ভারতে অঘোষিত বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে এসেই মওলানা ভাসানী জাতিকে হুশিয়ার করলেন, “ পিণ্ডির গোলামি ছিন্ন করেছি, দিল্লীর গোলামীতে আবদ্ধ হবার জন্য নহে”।
দিল্লীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সালের ১৭ই নবেম্বর পর্যন্ত যেসব বিষয়ের উপর সংগ্রাম করেছেন তা আজো অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার গুলু ঐ সব ইস্যুতে কথা বললেই চক্রান্ত শূরু হয়। সরকার বদল হয়ে যায়। এ প্রসংগে আমরা শেখ মুজিবুর রহমান ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসন আমরা উল্লেখ করতে চাই। এ দু’জন রাষ্ট্র নায়ককেই মওলানা ভাসানী দিল্লীর রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে স্বাধীনভাবে দেশ চালাতে সহযোগীতা করেছিলেন। বংগ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অনুসারী ছিলেন। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে তিনি দেশের ভালো কাজের জন্য স্নেহ ও আশির্বাদ করেছেন। মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামি লীগ নৌকার মাঝি হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বংগ বন্ধু হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদার আসন লাভ করেছিলেন। তাই বলে তিনি গুরুকে অশ্রদ্ধা করেননি। যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন তত দিন গুরুর পরামর্শ শুনেছেন। বহিঃশক্তির চাপ স্বত্ত্বেও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা করেছেন। যারা বলেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছেন। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তাদের ভিশন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে কখনও গড়ে উঠেনি। স্বাধীনতার উপর আগাত হানার জন্যই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে মওলানা ভাসানী যার পর নাই দুঃখিত ও শোকাভিভুত হয়েছিলেন এবং বার বার বলেছিলেন “ সব কিছু শেষ হয়ে গেছে”।
মওলানা ভাসানী আজীবন বাংগালি মুসলমানের জন্য যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছিলেন তা বংগ বন্ধু নিহত হবার মধ্য দিয়ে কি ভাবে নিঃশেষ হয়ে গেছে তা মওলানা ভাসানীর চাইতে আর কে বেশী বুঝদার ছিলেন? বংগ বন্ধুর হত্যার পর পরই মুক্তিযুদ্ধের ভিতর গেরিলা যুদ্ধ করতে করতে গড়ে উঠা সেনা বাহিনীকে ভিতর থেকে ধবংশ করার চক্রান্ত শুরু হয়েছিলো। বাহিরের শক্তির মদদে এক দল লোক সেনা বাহিনীর অফিসারদের বিরুদ্ধে সাধারন সিপাহীদের উসকানির জন্য “শ্রেনী সংগ্রামে”র নামে চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছিল। বহু সেনা অফিসার হত্যার পর সাধারন সিপাহীরা চক্রতান্তের ভয়াবহতা, সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী মোতায়ের বাস্তবাতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বাংলার কৃষ কের স ন্তান এ সাধারন সিপাহীরা সে দিন কোন উপায় খুজে না পেয়ে দেশের সাদাহারম মানুষের সাথে মিশে আর একবার মুক্তি যুদ্ধ শূরু করার নিয়ত করে। ১৯৭৫সালের ৭ই নবেম্বর অতি প্রত্যুষে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করলেন। চক্রান্ত কারীরা আর একটি মুক্তি যুদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশ ভারতের নিরকুশ আধিপত্য স্থাপনের জন্য চেয়েছিল। সিপাহী জনতার বিপ্লবে ভীত হয়ে চক্রান্ত কারীরা আর বেশীদুর বাড়লো না। সাধারন সিপাহীরা জিয়াউর রহমান কে মুক্ত করে জাতির সামনে নিয়ে আসেন। সিপাহী জনতার ঐক্য শক্কির উপর ভিত্তি করে ক্ষমতার নব বন্যাস হলো। জেনারেল জিয়া সাধারন সিপাহী-জনতার বিপ্লব ও মওলানা ভাসানীর সমর্থনে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসীন হন। মওলানা ভাসানীর বয়স তখন ৯৬ বছর। বয়স তাকে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি দেশের স্বাধীনতার উপর সীমান্ত হামলা প্রতিরোধ কল্পে অসুস্থ শরীর নিয়েও একটির পর একটি জনসভা করেছেন। এদিকে জেনারেল জিয়া বিশৃংখল সেনাবাহিনীকে দ্রুত সংঘটিত করছিলেন। কাজটি সহজ ছিল না। সেনাবাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিদেশী শত্রুছিল স্তরে স্তরে বিছানো। প্রথমেই আসা যা’ক তার বিমান বাহিনী প্রধান ভাইস মার্শাল এম, জি, তোয়াবের কথা। এ লোকটি এ সময়ে নবী দিবস পালন উপলক্ষ্যে ভারতীয় হস্তক্ষেপের সুবিধা করে দেবার জন্য মৌলবাদী পন্থা গ্রহন করলেন। অনুষ্ঠানে শ্লোগান উঠলো, “তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই- চাঁদ তারা পতাকা চাই”। পরদিন মওলানা ভাসানী এক কড়া বিবৃতির মারফত এ লোকটির মুখোশ উন্মোচন করে দিলে সে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়। আমি মনে করি সেনাবাহিনীকে এ সময় সংগঠিত করার কাজটি ছিল জেনারেল জিয়ার সর্বোচ্চ কৃতিত্ব।
এ অবস্থার মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৬ই মে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ভারত কর্তৃক ফারাক্কায় গংগা নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহারে প্রতিবাদে লক্ষাধিক জনতার মিছিল রাজশাহী শহর থেকে কান্সার্ট সীমান্ত পর্যন্ত নেতৃত্ব দেন। এ মিছিলের পর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আগ্রাসীরুপ বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। ভারতীয় চরদের আভ্যন্তরিন নাশকতা থেকে দেশ আপাততঃ পায়। মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালেড় ফেব্রুয়ারী মাসে জাতীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন। বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র আরব দেশসহ বিশ্বব্যাপী তূলে ধরা ও পবিত্র হজ্জব্রত পালনের লক্ষ্যে তিনি ১৯শে নভেম্বর মক্কা শরিফের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেবার আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাস্পাতালে স্বাস্থ্য পরিক্ষা করাতে ভর্তি হন। কিন্তু আমাদেরে জন্য অতি দুঃখজনক হলো এই যে, ১৭ই নভেম্বর এ মহান জাতীয় নেতা জাতিকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ইন্তেকাল করেন। তাঁর আগে ১৩ই নভেম্বর তিনি সন্তোষে থেকে দেশ ও জাতির জন্য যে দিকদর্শন দিয়ে গেছেন তা হলোঃ
*(১)“সাম্য, মুক্তি ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা”র লক্ষ্যে রবুবিয়াত কায়েম,
(২) বাংগালি মুসলমানের আধ্যাত্তিক সাধনায় নির্মিত বাংগালি জাতীয়তাবাদের চর্চা ও
(৩) নদীর পানি ও পরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আজ আমাদের মাঝে নেই। তাঁর দিকনির্দেশনা আমাদের জন্য রয়েছে। যারা এ ম হান নেতার দিক নির্দেশনা মানবেন তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাম্য, দাসত্বের বিরুদ্ধে মুক্তি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই করবেন। তারা নিজ থেকেই করবেন। এ জন্য মওলানা ভাসানী উত্তরাধিকারী হবার দরকার নাই। অনেকেই হায় হায় করেন! নাকি কান্না করেন! আর বলেন, “আজ যদি মওলানা ভাসানী থাকতেন, তা হলে এমনটি হতো না”। যারা এ সব কথা বলেন, তারা আরাম কেদারায় বসে তা বলেন। এদের মধ্যে এমন লোকও আছে যাদের বাবারা জমিদার বাড়িতে ছালার চটে বসতেন। আজ এ সবলোক সমাজের উচ্চাসনে বসে বিদেশি আধিপত্য ও সামাজিক বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেয়। যা’ হউক মওলানা ভাসানী সুচীত লড়াইয়ের উত্তরাধীকার লাগে না। প্রতিদিন সমাজে বৈষম্যের কাঠামো তৈরী হচ্ছে। আর মানুষ এ কাঠামোতে মাকড়শার জালের মত জড়িয়ে পড়ছে। অন্যায়কারী বাড়ছে। সম্পত্তির অধিকারীর উত্তরাধিকারী দরকার। মওলানা ভাসানী উত্তরাধীকার, সম্পত্তির অধিকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। রবুবিয়াতের মতে আকাশ পাতলের সকল কিছুর মালিক মহান পালনকারী আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। ব্যাক্তির মালিকানাই সব সমস্যার মুল কারন। তিনি বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করেছেন। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করেছেন। যারা জমিদারদের পায়ের উপর উপুত হয়ে সালাম করেছেন তাদের মুক্ত করেছেন। এটাই তো স্বাধীনতা। এর পর জাতিকে মুক্ত করার লড়াই শিখিয়েছেন । আজো ভারত ও পাকিস্তানে জমিদারী প্রথা বিদ্যমান। এ দু'রাষ্ট্রে জ়মিদার শ্রেনী আজো ক্ষমতা চালায়। বাংলাদেশ এ দু'টি জমিদার রাষ্ট্রের চক্ষুশুল। অরুন্ধুতির লেখা পড়ূন। নকশালরা জমির অধিকার চায় বলেই তাদের উপর এত অত্যাচার। বাংলাদেশে ভারত আমাদের অজান্তে ক্ষমতার খেলায় জমিদার শ্রেনী তৈরী করেছে। তারা খুব শীগ্রই বাংলাদেশের মানুষকে উপুত করে সালাম করাবে। তখন মওলানা ভাসানীর অনুসারী মিলবে। তার আগে নয়। তবে লালনপন্থী বাউলরা মুক্তির গান গায়। মুক্তির গানের উত্ত্বরাধীকারী লাগে না। মুক্তি সকলেই চায়। এখানে মানুষ অলক্ষ্যে মওলানা ভাসানীর অনুসারী। গরীর লড়াকু মানুষেরা নিজ সন্তানের নাম ভাসানী রাখে। গ্রাম বাংলায় খুঁজলে কম পক্ষ্যে দশ হাজার মানুষের নাম পাওয়া যাবে যাদের নাম বাবা-মা আদর করে ভাসানী রেখেছে। মওলানা ভাসানী আমাদের ম হান জাতীয় নেতা, আমাদের জীবনের বেকন- গভীর আঁধার রাতে দুর সমুদ্রগামি জাহাজের নাবিকের জন্য আলোক স্তম্ব।
* ১৯৭১ সালের ৯ই জানুয়ারী স ন্তোষের কৃষক সম্মেলন থেকে সর্বশেষ স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষনায় বলেন,“স্বাধীন বাংলাদেশের কর্মসুচী সাম্য ও মুক্তির আদলে রচিত হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং সামাজিক ন্যায় বিচারে উদ্ধুদ্ধ হয়ে সাতকোটি পুর্ব পাকিস্তানী ইতিহাসের পাতায় সোনালী দিনের ঘোষনা দেবে”। উল্লেখ্য প্রবাসী সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে স্বাধীনতার অফিসিয়াল ঘোষনা দিলেন। এ ঘোষনায় তারা মওলানা ভাসানীর ঘোষনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করলেন এবং বাংলাদেশের মৌলিক নীতিমালা হিসেবে “সমতা, মানবতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষনা” করেছিলেন।
নিপীড়ণ গাথা ও বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালি জাতির উপর পাকিস্তানীদের নিপীড়ণের যথাযথ বর্ণনা। নিম্নে ভাষণটি তুলে ধরা হলো:
“ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বোঝেন আমরা জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম?
নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরী করব এবং এদেশের ইতিহাসকে গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনীতিক, রাজনীতিক ও সাংষ্কৃতিক মুক্তি পাবেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। এই রক্তের ইতিহাস মুমূর্ষু মানুষের করুণ আর্তনাদ—এদেশের ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি।১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খাঁ মার্শাল-ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খাঁর পতনের পরে ইয়াহিয়া এলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেব বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন— আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আমাদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দিন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সভা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব— এমনকি এও পর্যন্ত বললাম, যদি ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনের মতেও যদি তা ন্যায্য কথা হয়, আমরা মেনে নেব।
ভুট্টো সাহেব এখানে ঢাকায় এসেছিলেন আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম— আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরী করব। সবাই আসুন, বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরী করব। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যারা যাবে, তাদের মেরে ফেলে দেওয়া হবে। আর যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত সব জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। আর হঠাৎ মার্চের ১লা তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, যাবো। ভুট্টো বললেন, যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষের, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলো।
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। আমি বললাম, আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র পেয়েছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য। আজ সেই অস্ত্র দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধে— তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু— আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আমি বলেছিলাম জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের ওপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কিভাবে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, আপনি দেখুন। তিনি বললেন, আমি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকব।
আমি বলেছি কীসের এসেম্বলি বসবে? কার সঙ্গে কথা বলব? আপনারা যারা আমার মানুষের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলব? পাঁচ ঘন্টা গোপন বৈঠকে সমস্ত দোষ তারা আমাদের বাংলার মানুষের ওপর দিয়েছেন, দায়ী আমরা।
২৫ তারিখে এসেম্বলি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ১০ তারিখে বলেছি, রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের ওপর পাড়া দিয়ে, এসেম্বলি খোলা চলবে না। সামর