27/01/2020
Good afternoon friends.
রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সমগ্র
‘আমি ভ্রমণ করতে ভালবাসি, কিন্তু ভ্রমণের কল্পনা করতে আমার আরও ভালো লাগে’ রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ ভ্রমণসূচির দিকে তাকালে প্রথমেই মনে পড়ে তাঁর এ-উক্তিটি। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশেই ঘুরেছেন তিনি। ভারতের এমন কোনো বড় শহর নেই যেখানে তিনি যাননি। নদীমাতৃক বাংলায় ভ্রমণ করেছেন দিনের পর দিন। বলতেন, পাহাড় তাঁর তেমন প্রিয় নয়, তবু তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ ‘হিমালয় যাত্রা’, শেষবারের ভ্রমণ তালিকায় রয়েছে কালিম্পঙ।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন সতেরো, তাঁর মেজোদাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর কর্মস্থল আমেদাবাদে গেলেন। সত্যেন্দ্রনাথের সরকারি বাসস্থান ছিল শাহীবাগের বাদশাহী প্রাসাদ। ‘আমেদাবাদে এসে এই প্রথম দেখলুম চলতি ইতিহাস থেমে গিয়েছে, ... তার সাবেক দিনগুলো যেন যক্ষের ধনের মতো মাটির নীচে পোঁতা।’ উপযুক্ত আধার পেয়ে শাহীবাগ নিজের রহস্য উজাড় করে দিলো কবির কাছে। অনেকদিন পরে লেখা ক্ষুধিত পাষাণ, শাহীবাগ ভ্রমণের স্মৃতি নিয়ে জীবন্ত। রবীন্দ্রনাথের আগ্রাযাত্রার ভ্রমণকাহিনি কোথাও নেই। এলাহাবাদে এসে স্মৃতিমন্থন করে লিখেছিলেন অবিস্মরণীয় দুটি কবিতা ‘শাজাহান’ ও ‘তাজমহল’।
কবি অনেক আশা নিয়ে জ্যোতিদাদার সঙ্গে দার্জিলিংয়ে গেলেন এবং লিখলেন ‘আমি দেবদারুবনে ঘুরিলাম, ঝরনার ধারে বসিলাম, তাহার জলে স্নান করিলাম, কাঞ্চনশৃঙ্গার মেঘমুক্ত মহিমার দিকে তাকাইয়া রহিলাম’। কিন্তু মন ভরল না। বরং সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল কারোয়ারে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক শোভা দেখে মোহিত হয়েছিলেন, ‘এই ক্ষুদ্র শৈলমালাবেষ্টিত সমুদ্রবন্দরটি এমন নিভৃত, এমন প্রচ্ছন্ন যে, নগর এখানে নাগরীমূর্তি প্রকাশ করিতে পারে নাই। অর্ধচন্দ্রাকার বেলাভূমি অকূল নীলাম্বুরাশির অভিমুখে দুই বাহু প্রসারিত করিয়া দিয়াছে - সে যেন অনন্তকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিবার একটি মূর্তিমতী ব্যাকুলতা।’
রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৫ সালে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার আগ্রহে তাঁদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে হাজারিবাগ বেড়িয়ে এসে লিখেছিলেন ‘দশ দিনের ছুটি’। প্রশান্তকুমার পাল এই লেখাটির একটি প্রাথমিক খসড়ার উল্লেখ করেছেন, ‘রবীন্দ্রভবন সংগ্রহভুক্ত ছোটো একটি নোটবুকে এই রচনাটির পেনসিলে লেখা প্রাথমিক খসড়া পাওয়া যায় - ‘৮ দিনে বেশি কি হবে। একবার প্রকৃতির মধ্যে উঁকি মারা, পৃথিবীটা যে ইট সুরকীতে গড়া নয় তার প্রমাণ পাওয়া।’ এই সামান্য স্কেচ থেকে রবীন্দ্রনাথ ফিরে এসে লিখেছিলেন, ‘অদূরে দুইটি পাহাড় দেখা যাইতেছে তাহার মধ্য দিয়া উঠিয়া নামিয়া পথ গিয়াছে। যেখানেই চাহি চারিদিকে লোক নাই, লোকালয় নাই, শস্য নাই, চষা মাঠ নাই; চারিদিকে উঁচু নিচু পৃথিবী নিস্তব্ধ নিঃশব্দ কঠিন সমুদ্রের মতো ধূধূ করিতেছে। দিক দিগন্তরের উপরে গোধূলিরা চিকচিকে সোনালি অাঁধারের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে।’ এখানে তাঁরা মানুষে-ঠেলা পুশপুশে চেপেছিলেন। কবি বর্ণনা দিয়েছেন, ‘আর রেলগাড়ি নাই। এখন হইতে ডাকগাড়িতে যাইতে হইবে। ডাকগাড়ি মানুষে টানিয়া লইয়া যায়। একে কি আর গাড়ি বলে? চারটে চাকার উপর একটা ছোট খাঁচা মাত্র। সেই খাঁচার মধ্যে আমরা চারজন চারটি পক্ষীশাবকের মতো কিচির মিচির করিতে করিতে প্রভাতে যাত্রা করিলাম।’ ফেরার সময় ‘সময় সংক্ষেপ করিবার উদ্দেশ্যে দুই চাকার ছোটো গাড়িতে করিয়া আসিয়াছিলাম। আর কিছু না হউক তাহাতে পরমায়ু সংক্ষেপ হইয়াছে।... যে পঞ্চভূতে শরীরটা নির্মিত সেই পাঁচ ভূতে ভূতের নাচন নাচিয়াছে।’
রবীন্দ্রনাথ মাসখানেক ছিলেন সোলাপুরে। পরিচয় গাঢ় হয়েছিল বালিকাবধূর সঙ্গে। বছর কয়েক পরে সোলাপুর বাসের সুখস্মৃতির কথা লিখেছিলেন তাঁদের পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তকে। ‘বছর তিন-চারের পূর্বে একটি শরৎকাল আমি অন্তরের সহিত উপভোগ করিয়াছিলাম। বাড়ির প্রান্তে একটি ছোট্ট ঘরে একটি ছোট্ট ডেস্কের সম্মুখে বাস করিতাম। আরো দুএকটি ছোট আনন্দ আমার আশেপাশে আনাগোনা করিত। সে বৎসর যেন আমার সমস্ত জীবন ছুটি লইয়াছিল। আমি সেই ঘরটুকুর মধ্যে থাকিয়াই জগতে ভ্রমণ করিতাম এবং বহির্জগতের মধ্যে থাকিয়াও ঘরের ভিতরটুকুর মধ্যে যে স্নেহ প্রেমের বিন্দুটুকু ছিল তাহা একান্ত আগ্রহের সহিত উপভোগ করিতাম।’
রবীন্দ্রনাথকে সপরিবারে আবার দার্জিলিং যেতে দেখা গেল। তবে এবার তাঁর ভূমিকা অন্যরকম, তিনি যাত্রীদলের অভিভাবক। তাই ‘সারা ঘাটে স্টিমারে ওঠবার সময় মহা হাঙ্গাম। রাত্রি দশটা - জিনিসপত্র সহস্র, কুলি গোটাকতক, মেয়ে মানুষ পাঁচটা এবং পুরুষ মানুষ একটি মাত্র।’ এরপরে দার্জিলিংয়ে পৌঁছানোর সরস বর্ণনা, ‘ক্রমে ঠান্ডা, তারপরে মেঘ, তারপরে নদিদির সর্দি, বড়দিদির হাঁচি, তারপরে শাল-কম্বল-বালাপোষ, মোটা মোজা, পা কন্কন্, হাত ঠান্ডা, মুখ নীল, গলা ভারভার এবং ঠিক তার পরেই দার্জিলিঙ।’ যেটুকু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে বাদ দিয়েছিলেন সংগত কারণে, সেটুকু লিখে দিয়েছেন স্বর্ণকুমারী দেবী, ‘আমরা যদিও এই নূতন দার্জিলিঙে আসিয়াছি, কিন্তু আমাদের অভিভাবকটি... আগে আরেকবার আসিয়াছিলেন।... তিনি যত বাড়ি ঘর দেখিতেছেন ততই প্রফুল্ল হইয়া উঠিতেছেন; তাঁহার পূর্বস্মৃতি ততই নূতন হইয়া উঠিতেছে, গতবারে যে বাড়িতে ছিলেন তাহার কাছে যে ঝরনাটি ছিল সেটি পর্যন্ত তিনি আমাদের দেখাইলেন, সবই মিলিয়া গেল, এখন কেবল গাড়ি থামিলে হয় - দার্জিলিঙে নামা মাত্র বাকী। গাড়িও থামিল, তিনি চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন আমাদের কেহ লইতে আসিয়াছে কি না।... আমাদের ভাবগতিক দেখিয়া একজন কুলি বলিল - গুম গুম (ঘুম) স্টিসন উতরেগা?’ পরে রবীন্দ্রনাথ আরো কয়েকবার দার্জিলিংয়ে গিয়েছেন। একবার ত্রিপুরারাজের অনুরোধে সেখান থেকে কার্শিয়াং। শেষ বয়সে কয়েকবার মংপু ও কালিম্পঙ। তবে দার্জিলিংয়ে বেড়াবার প্রসঙ্গ বিশেষ না থাকলেও ছিন্নপত্রে কয়েকটি স্মরণযোগ্য ক্ষণখন্ডের যে উল্লেখ আছে তাতে ‘দার্জিলিঙে সিঞ্চল শিখরের একটি সূর্যাস্ত ও চন্দ্রোদয়’ স্থান করে নিয়েছে। বেড়াতে গিয়ে কবি কী দেখলেন এবং কখন তা তাঁর স্মৃতির মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে রইল তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার পাশে হয়তো হারিয়ে গেল আস্ত দার্জিলিং।
রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন বাস করেন গাজিপুরে, স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে। এত জায়গা থাকতে গাজিপুরে কেন, সে-প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন, ‘শুনেছিলুম গাজিপুরে আছে গোলাপের ক্ষেত, ... তারি মোহ আমাকে প্রবলভাবে টেনেছিল।’ গাজিপুরে কবি একটি বাড়িও কিনেছিলেন। অনেক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে কবির সেখানে থেকে যাবার ইচ্ছে বহুবার দেখা গিয়েছে। গাজিপুর থেকে তাঁকে শিলাইদহে যেতে হলো দেবেন্দ্রনাথের আদেশে জমিদারি পরিদর্শনে। এবার কাজের সঙ্গে মিশে গেল ভ্রমণ। উত্তরাধিকারসূত্রে উঠলেন পিতামহের ‘পদ্মা’ বোটে। নামকরণ করেন পৌত্র। এই বিশাল বোটটি কবির অত্যন্ত প্রিয় ছিল। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর অজস্র ভ্রমণস্মৃতি।
‘শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকান্ড চর - ধূধূ করছে - কোথাও শেষ দেখা যায় না - কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায় - আবার অনেক সময় বালিকে নদী বলে ভ্রম হয় - গ্রাম নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই, বৈচিত্র্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি - পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে অনন্ত পান্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূন্য, নীচে দরিদ্র কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূন্যতা।... হঠাৎ পশ্চিমে মুখ ফেরাবামাত্র দেখা যায় স্রোতোহীন ছোটো নদীর কোল, ওপারে উঁচু পাড়, গাছপালা, কুটীর, সন্ধ্যাসূর্যালোকে আশ্চর্য স্বপ্নের মতো। ঠিক যেন এক পারে সৃষ্টি এবং আর এক পারে প্রলয়। সন্ধ্যাসূর্যালোক বলবার তাৎপর্য এই - সন্ধ্যার সময়েই আমরা বেড়াতে বেরোই এবং সেই ছবিটাই মনে অঙ্কিত হয়ে আছে। পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ-সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।’ প্রকৃতির এই রূপের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হলো শিলাইদহে এসেই।
রবীন্দ্রনাথের কাছে ভ্রমণ ছিল সাধনা। তিনি বলেছেন, ‘পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়, পথের দুধারে আছে মোর দেবালয়।’ রবীন্দ্রনাথের এই প্রথম সমুদ্রযাত্রা। কবিকে সমুদ্রপীড়া কাবু করেছিল বলে ভালো লাগেনি, লিখেছেন ‘কলকাতায় সমুদ্রকে যা মনে করতেম, সমুদ্রে এসে দেখি তার সঙ্গে অনেক বিষয় মেলে না। তীর থেকে সমুদ্রকে খুব মহান বলে মনে হয়, কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে এলে আর ততটা হয় না।’ পরে বহুবার সমুদ্রযাত্রার ফলে রবীন্দ্রনাথের চোখে সমুদ্রের রূপ ধরা পড়েছিল। য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র ছাড়াও তাঁর অধিকাংশ ভ্রমণকথা লেখা হয়েছে চিঠি বা ডায়েরি হিসেবে। প্রথম দর্শনে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন প্যারিস দেখে ‘কী জমকালো শহর। অভ্রভেদী প্রাসাদের অরণ্যে অভিভূত হয়ে যেতে হয়’। সেখান থেকে লন্ডন ‘এমন বিষণ্ণ অন্ধকারপুরী আর কখনো দেখিনি - ধোঁয়া, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা, কাদা আর লোকজনের ব্যস্তসমস্ত ভাব।’
প্রায় দেড় বছর পরে রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসেন। অসময়ে বিলেত থেকে ফিরে আসায় পরিচিতজনেরা কিছু কিছু বিরূপ মন্তব্য করলে কবি স্থির করলেন আবার বিলেত যাবেন। দেবেন্দ্রনাথ আপত্তি করেননি। কিন্তু মাদ্রাজে গিয়েও ফিরে আসতে হলো রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার ইউরোপে যান ১৮৯০ সালে। প্রথম বিদেশযাত্রার এক যুগ পরে। এবারে তিনি সমগ্র যাত্রাপথের একটি ডায়েরি রেখেছিলেন, তার ফলে প্রাত্যহিক ভ্রমণবৃত্তান্ত পাওয়া যায়। যেমন লিখছেন, ‘৩ সেপ্টেম্বর। বেলা দশটার সময় সুয়েজ খালের প্রবেশমুখে এসে জাহাজ থামল। চারিদিকে চমৎকার রঙের খেলা। পাহাড়ের উপর রৌদ্র, ছায়া এবং নীলিম বাষ্প। ঘন নীল সমুদ্রের প্রান্তে বালুকাতীরের রৌদ্রদুঃসহ পীত রেখা।’ ... ৬ সেপ্টেম্বর। ... ‘আয়োনিয়ান’ দ্বীপ দেখা দিয়েছে। পাহাড়ের কোলের মধ্যে সমুদ্রের ঠিক ধারেই মনুষ্যরচিত ঘনসন্নিবিষ্ট একটি শ্বেত মৌচাকের মতো দেখা যাচ্ছে। এইটি জান্তি শহর। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন পর্বতটা তার প্রকান্ড করপুটে কতকগুলো শ্বেতপুষ্প নিয়ে সমুদ্রকে অঞ্জলি দেবার উপক্রম করছে।’ ভ্রমণ শুধু প্রকৃতিকে দেখা নয়, পারিপার্শ্বিকও তার মধ্যে পড়ে। প্রথমবারে কবি সুয়েজ খাল দেখেননি, এবার দেখলেন এশিয়া ও আফ্রিকার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তাঁর মনে হলো, ‘এমনি করে সভ্যতা সর্বত্রই জলে স্থলে দেশে গৃহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিয়ে আপনার পথটি করে নেবার চেষ্টা করছে।’ রেলপথে পাড়ি দিতে দিতে ইউরোপের শস্যক্ষেত্র-শাকসবজি বাগান দেখে কবি মুগ্ধ হয়েছেন। ‘এই কঠিন পর্বতের মধ্যে মানুষ বহুদিন থেকে বহুযত্নে প্রকৃতিকে বশ করে তার উচ্ছৃংখলতা হরণ করেছে।’
প্যারিসে ‘বিস্তর মূল্য দিয়ে ঈফেল স্তম্ভ দেখতে গেলেম।’ চারতলার ওপর থেকে ‘সমস্ত প্যারিসটাকে খুব একটা বড়ো ম্যাপের মতো প্রসারিত দেখতে পেলুম।’ লন্ডনে পৌঁছে কবি চেষ্টা করেছিলেন পূর্বপরিচিতদের সঙ্গে দেখা করতে, দেখা হয়নি। এবারে তিনি বেশ কয়েকটি অপেরা, নাটক ও চিত্র-প্রদর্শনী দেখেছিলেন কিন্তু তিনি কখনো পিতামহের সমাধি দেখতে গিয়েছিলেন কি না জানা যায়নি। ফেরার পথে তিনি ব্রিন্দিসির গোরস্তান দেখতে গিয়েছিলেন হাতে সময় ছিল বলে। একাই ফিরছিলেন এবার। ‘এখানকার গোর নূতন রকমের। অধিকাংশ গোরের উপরে এক একটা ছোট ঘর গেঁথেছে। সেই ঘর পর্দা দিয়ে, ছবি দিয়ে, রঙিন জিনিস দিয়ে নানারকমে সাজানো, যেন মৃত্যুর একটা খেলাঘর... গোরস্থানের এক জায়গায় সিঁড়ি দিয়ে একটা মাটির নীচেকার ঘরে নাবা গেল। সেখানে সহস্র সহস্র মড়ার মাথা অতি সুশৃংখলভাবে স্তূপাকারে সাজানো।’ হয়তো একা বলেই এবার সমুদ্রের রূপ খানিকটা তাঁর চোখে ধরা দিলো অন্যভাবে, ‘দক্ষিণে জ্বলন্ত কনকাকাশ এবং অগ্নিবর্ণ জলরাশির মধ্যে সূর্য অস্ত গেল এবং বামে সূর্যাস্তের কিছু পূর্ব হতেই চন্দ্রোদয় হয়েছে - জাহাজ থেকে পূর্ব দিগন্ত পর্যন্ত বরাবর জ্যোৎস্নারেখা ঝিকঝিক করছে - পূর্ণিমার সন্ধ্যা যেন নীল সমুদ্রের ওপর আপনার শুভ্র অঙ্গুলি স্থাপন করে আমাদের এই জ্যোৎস্নাপুলকিত পূর্বভারতবর্ষের পথ নির্দেশ করে দিচ্ছে।’
ওড়িশায় নিজের মহাল দেখতে যাবার সময় কবি পুরী গিয়েছিলেন পালকি চেপে। রবীন্দ্রনাথ মন্দিরে যাননি, পথের বর্ণনা দিয়েছেন, ‘যত পুরীর নিকটবর্তী হচ্ছি তত পথের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যা বেশি দেখতে পাচ্ছি। ঢাকা গোরুর গাড়ি সারি সারি চলেছে। রাস্তার ধারে, গাছের তলায়, পুকুরের পাড়ে লোক শুয়ে আছে, রাঁধছে, জটলা করে রয়েছে। মাঝে মাঝে মন্দির, পান্থশালা, বড়ো বড়ো পুষ্করিণী। পথের ডান দিকে একটা খুব মস্ত বিলের মতো - তার ওপারে পশ্চিমে গাছের মাথার উপর জগন্নাথের মন্দির চূড়া দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ এক জায়গায় গাছপালার মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়েই সুবিস্তীর্ণ বালির তীর এবং ঘন নীল সমুদ্রের রেখা দেখতে পাওয়া গেল।’ এই দর্শনের ফসল ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতা। পুরীতেও কবি বাস করবেন ভেবে একটা জমি কিনেছিলেন।
১৮৯৫ সালে কবির আবার বিদেশ যাবার ইচ্ছে হলো। ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন, ‘ইচ্ছে করছে কোন একটা বিদেশে যেতে, - বেশ একটা ছবির মতো দেশ - পাহাড় আছে, ঝর্ণা আছে, পাথরের গায়ে খুব ঘন শৈবাল হয়েছে, দূরে পাহাড়ের ঢালুর উপরে গোরু চরছে, আকাশের নীল রঙটি খুব স্নিগ্ধ এবং সুগভীর, পাখি-পতঙ্গ-পল্লব এবং জলধারার একটা বিচিত্র মৃদু শব্দমিশ্র উঠে মস্তিষ্কের মধ্যে ধীরে ধীরে তরঙ্গাভিঘাত করছে।... আজ আর কিছুতে হাত না দিয়ে দক্ষিণের ঘরে একলাটি হতে পা ছড়িয়ে একটা কোনো ভ্রমণবৃত্তান্তের বই নিয়ে পড়ব মনে করছি - বেশ অনেকগুলো - ছবিওয়ালা নতুন-পাতা-কাটা বই।’
বেশ কয়েক বছর রবীন্দ্রনাথের বিদেশ যাওয়া হয়নি। দেশের মধ্যে অনেক জায়গায় গিয়েছেন - সাঁওতাল পরগনার কার্মাটার থেকে শুরু করে সিমলা, মুসৌরী ছাড়া গিয়েছেন ত্রিপুরায়। সেখানকার জুড়ি বাংলায় বাঁশ, বেত ও কাঠে তৈরি ঘরে বাস করে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন। মজফফরপুরে গিয়েছেন কন্যা মাধুরীলতা দেবীকে নিয়ে, তাঁর নতুন সংসারে পৌঁছে দিতে।
মৃণালিনী দেবীর অসুস্থতা ও মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় কন্যা রেনুকার অসুস্থতা তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে রেনুকাকে নিয়ে গেলেন আলমোরা। কবি লিখছেন, ‘অতি দুর্গম পথ’। অবশ্য ‘জায়গাটি রমণীয় - বাতাসটি সুশীতল, আমাদের বাড়িটি বৃহৎ, চারদিকের বাগানটি সুন্দর, আমাদের গৃহস্বামীটি অতিথিবৎসল, অতএব ক্ষোভের বিষয় এখন আর কিছুই নাই।’ এমনকি ‘মাঝেমাঝে কুহেলিকার আবরণ সরিয়া গিয়া তুষারশিখরশ্রেণীর আভাস দেখিতে পাওয়া যাইতেছে।’ যদিও ‘প্রান্তর আমার মন ভুলাইয়াছে পর্বতকে আমি এখনো হৃদয় দিতে পারি নাই।’ ইন্দিরা দেবীও লিখেছেন একবার তাঁদের অনুরোধে কবি তিনধারিয়াতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন কিন্তু বলতেন, ‘পাহাড়ে জায়গা তাঁর তেমন ভালো লাগে না। কারণ চারদিকে পাহাড় ঘিরে থাকে, দৃষ্টিকে বাধা দেয়। তিনি পছন্দ করেন উন্মুক্ত প্রান্তর - যেমন শান্তিনিকেতনে দেখা যায়, যেখানে দৃষ্টি দিগন্তের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক ঋতুকে যেন এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা করতে পারে।’
চিকিৎসকের নির্দেশে নিজের ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে কিছুদিন বিশ্রাম করতে কবি গিয়েছিলেন মজফফরপুর ও গিরিডি। গিরিডিতে স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো। তাঁর সঙ্গে গিরিডিতে বেড়ানোর স্মৃতিকথা লিখেছেন তাঁর ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মা, ‘কবির সঙ্গে বেড়ানো - গিরিডিতে - আর এক আনন্দ। পদযাত্রাকে তিনিই সরব করে রাখতেন। আশপাশের গাছগাছড়া, মাটির কথা - ফুল-পাতা, পাখি কারো কথা বলতে বাদ দিতেন না - চল্তে চল্তে।’ এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণবৃত্তান্ত বহু আলোচনার পরেও অজানা রয়ে গিয়েছে।’ যেমন, গিরিডির এই ভ্রমণ, উশ্রী জলপ্রপাত দেখে তার নামকরণ করেছিলেন ‘অশ্রু - তারই বা কত ব্যাখ্যা’। এখান থেকে তাঁরা একটি বড় দলে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধগয়া।
তাঁর কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথ মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কবি আশ্চর্য স্থৈর্য নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দৌহিত্র নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে মীরা দেবীকে কবি লিখেছিলেন, ‘শমী যে রাত্রে গেল তার পবের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বল্লে কম পড়েনি - সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে।’
রবীন্দ্রনাথ তৃতীয়বার বিদেশযাত্রা করেন ১৯১২-তে। বিদেশ যাবার আগে বোম্বাই দেখলেন ভালো করে ‘আমার ভারি ভালো লাগল যখন দেখলুম শত শত নরনারী সাজসজ্জা করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসেছে, অপরাহ্ণের অবসরের সময় সমুদ্রের ডাক অমান্য করতে পারেনি।’ এবার লন্ডনে এসে দেখলেন নতুন উপসর্গ মোটরগাড়ি। ‘মোটর রথ, মোটর বিশ্বম্বহ (অম্নিবাস), মোটর মালগাড়ি লন্ডনের নাড়িতে নাড়িতে শতধারায় ছুটে চলেছে।’ প্রথমে কবি উঠলেন হোটেলে, যদিও তাঁর হোটেল ভালো লাগে না ‘মনে হল এখানকার লোকালয়ের দেউড়িতে আনাগোনার পথে এসে বসলুম।’ বন্ধু উইলিয়ম রোদেনস্টাইন বাসস্থান ঠিক করে দিলেন হাম্পস্টেডহীথে। লন্ডনের বিদ্বৎসমাজের সঙ্গে কবির শুধু পরিচয় হলো তা নয়, তিনি তাঁদের অন্তর স্পর্শ করলেন। গীতাঞ্জলির অনুবাদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
রবীন্দ্রনাথ নিউইয়র্ক যাত্রা করেন অক্টোবর মাসে। এই প্রথম তাঁর আমেরিকা ভ্রমণ। এ-যাত্রায় তিনি ইলিনয়, বস্টন, হার্ভার্ড, শিকাগো প্রভৃতি অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। দুমাস পরে লিখেছিলেন, ‘এখানকার বড়ো শহরগুলোতে একবার নাড়া দিয়ে যাব। কি দেখতে আমেরিকায় এসেছি সে ত এখনো ঠিক জানতে পারিনি সেইটে জেনে যাব।’ কখনো অসহিষ্ণু হয়ে লিখেছেন, ‘আমার মতন এমন পলাতক মন বোধ হয় আর কারও নয়।’ যে-কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিশেষ করে সূর্যোদয় তাঁর বড় প্রিয় ছিল। আরবানার একটি সকাল কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, ‘আজ সকালে সূর্যোদয় হয়েছে। এ কী সুন্দর শোভা। শীতকালের পত্রহীন গাছের ডালগুলো একেবারে আগাগোড়া হীরের মতো ঝলমল করছে - যেন উৎসব বাড়িতে সারি সারি স্ফটিকের ঝাড় লাগিয়ে দিয়েছে।’ আমেরিকা থেকে লন্ডনে ফিরে কবি আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
প্রতি পুজোর ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে যেতেন, আশ্রম বিদ্যালয়েও ছুটি থাকত। নৈনিতালের কাছে রামগড়ে রথীন্দ্রনাথ একটা বাংলো ও বাগান কিনেছিলেন, স্থির হলো সেখানেই কবি গরমের সময়টা কাটাবেন। অবশ্য পছন্দ হলে। পাহাড় ভালো না লাগলেও রামগড় কবির ভালো লাগল। সেখান থেকে অ্যান্ডরুজকে লিখলেন, ‘Here I feel that I have come to the place that I needed most in all the world... to-day, I am already bending my knees to father Himalaya asking pardon for keeping aloof for so long in blind distrust.
The hills all round seem to me like an emareld vessel brimming over with peace and sunshine. The solitude is like a flower spreading its petals of beauty and keeping its honey of wisdom at the core of its heart. My life is full. It is no longer broken and fragmentary.’ এই পরিপূর্ণ আনন্দের প্রকাশ ঘটল একটি গানে - ‘এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুনদর’। নিদারুণ ব্যস্ততার ক্লান্তি অনেকটাই কমে গেল। এ বছরেই পূজাবকাশে আবার বুদ্ধগয়া যাত্রা করেন, হরিদ্বারে যাবারও ইচ্ছে ছিল। বরাবর পাহাড়ের বৌদ্ধ গুহা, সে ‘গুহার দেওয়াল - সেই পাহাড়ের গা - আশ্চর্য রকম পালিশ করা - কাচের ন্যায় মসৃণ’ দেখার জন্য কবি কষ্টকর পথেও যাত্রা করলেন, পথশ্রমে গুহা না দেখেই ফিরে আসতে বাধ্য হন। এলাহাবাদে এসে কবি দেখলেন ইন্ডিয়ান প্রেস। আত্মীয়ের বাড়িতে কাদম্বরী দেবীর একটি ছবি। সেখান থেকেই আগ্রা ও দিল্লি ঘুরে আসেন। জয়পুর ভ্রমণের খবর পাওয়া যায়, অ্যান্ডরুজকে লিখেছেন, ‘This Jaipur trip has been a failure simply because we put at the house of a man we know and he tried to make it evident thet our visit was to him and not to Jaipur. He screwed in from everying that belonged to the place, only giving an occasional airing, scaring away others who were more eager and more competent then he was to help us in our mission.’ এও এক বিড়ম্বনা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পুজোর ছুটিতে কাশ্মিরে গেলেন নিমন্ত্রণ রাখতে। একদিন তিনি মার্তন্ড মন্দির দেখেছেন। লিখেছেন ‘বলাকা’ কবিতা। ‘বলাকা’র জন্মকথা বর্ণনা করেছেন পরে, ‘কাশ্মীরে শ্রীনগরের কার্তিকের নির্মল আকাশ। পদ্মার মত ঝিলম আমার পায়ের তলায়। সন্ধ্যা বেলায় ধীরে ধীরে ঝিলমের জলে অন্ধকার নেমে আসছে। বোটের ছাদে বসে আছি। নদীর স্রোত কালো হয়ে গেছে, ওপারে জমাট অন্ধকার, চারিদিক নিঃশব্দ নিস্তব্ধ। এমন সময় বুনো হাঁসের দল হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল।’ এই অপূর্ব বর্ণনাটি ছাড়া সর্বত্রই তাঁর ভালো না লাগার কথা লিখেছেন ‘যা হোক কাশ্মীরটা না দেখলে মনে একটা আক্ষেপ থেকে যেত সেইটে কেটে গেল এইটুকুই যা লাভ।’ কাশ্মির থেকে ফিরে শিলাইদহে পৌঁছে মনে হলো, ‘এমন শান্তি ও সৌন্দর্য আর কোথাও নেই - সেটুকু ফিরে অনুভব করবার জন্যে মাঝে মাঝে দূরে যাওয়া দরকার।’ তারপর তিনদিনের জন্যে গেলেন ঘাটশিলা। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভূস্বর্গ-ফেরত কবিকে অভিভূত করল। কুড়ি বছর পরে সেই ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘একটি ছবি মনে আছে, ছোটো বড়ো নানা উপলে বিভক্ত সুবর্ণরেখা নদী বয়ে চলেছে, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, অস্তগামী সূর্যের ম্লান ধূসর আলোয় একদল বক বসে আছে নদীবক্ষের মধ্যে একটি প্রশস্ত শিলাখন্ডের উপরে - প্রাণবান করেছে তারা সন্ধ্যার শান্তিকে।’ ঘাটশিলা তাঁর এত ভালো লেগেছিল যে-ভেবেছিলেন সেখানে একটা বাড়ি করে মাঝেমাঝে এসে থাকবেন।
আবার আমেরিকায় বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ এলো। প্রথমে কবি ভাবছিলেন পিঠাপুরমে যাবেন, তারপরে মহীসুরে। সুবিধে হলে কলম্বো হয়ে জাভা ও নিউজিল্যান্ড হয়ে কালিফোর্নিয়া ‘যতই দিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি সম্বন্ধ এক জায়গার সঙ্গে নয়।... অতএব বেরিয়ে পড়া যাক।’ শেষে স্থির হলো ‘প্যাসিফিক দিয়ে যেতে হবে অতএব জাপানের রাস্তাই সস্তা ও সহজ।’ বাণিজ্যিক শহর রেঙ্গুন তাঁর ভালো লাগেনি। প্রথম আনন্দ পেলেন সোয়েডগঞ্জ প্যাগোডা দেখে। ‘বহুকালের বৃহৎ ব্রহ্মদেশ এই মন্দিরটুকুর মধ্যে আপনাকে প্রকাশ করলে। রেঙ্গুন শহরটা এর কাছে ছোট মনে হল।’ অবশ্য পিনাং বন্দরও তাঁকে বঞ্চিত করেনি, ‘সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছে তখন পিনাঙের বন্দরে জাহাজ এসে পৌঁছল। মনে হল, বড়ো সুন্দর এই পৃথিবী। জলের সঙ্গে স্থলের যেন প্রেমের মিলন দেখলুম। ধরণী তার দুই বাহু মেলে সমুদ্রকে আলিঙ্গন করছে। মেঘের ভিতর দিয়ে নীলাভ পাহাড়গুলির উপরে যে একটি সুকোমল আলো পড়েছে সে যেন অতি সূক্ষ্ম সোনালি রঙের ওড়নার মতো; তাতে বধূর মুখ ঢেকেছে না প্রকাশ করছে, তা বলা যায় না।’ হংকংয়ে কবি মুগ্ধ হলেন চীনা শ্রমিকদের দেখে। ‘এমন শরীর কোথাও দেখিনি, এমন কাজও না। একেবারে প্রাণসার দেহ, লেশমাত্র বাহুল্য নেই। কাজের তালে তালে সমস্ত শরীরের মাংশপেশী কেবলই ঢেউ খেলাচ্ছে।... জাহাজের ঘাটে মাল তোলা-নামার কাজ দেখতে যে আমার এত আনন্দ হবে, একথা আমি পূর্বে মনে করতে পারতুম না।’ হংকংয়ে তিনি যে দড়ি-টানা ডুলিতে চেপে পাহাড় দেখতে গিয়েছিলেন সে-কথাটিও চাপা পড়ে গেছে।
একই কথা চিঠিতে লিখেছেন, ‘এখন আমরা রেলগাড়িতে, টোকিও শহরের দিকে চলেছি। দুধারে পাহাড়, ধানের ক্ষেত, তুঁতের বন (রেশম চাষের জন্যে) পাইনের অরণ্য, বর্ষার জলে ভরা ছোট ছোট নদী - সমস্ত জাপান দেশটা যেন আগাগোড়া ছবির পর ছবি - আর এখানকার লোকেরাও তেমনি সৌন্দর্য অন্তরের সঙ্গে ভালোবাসে। আর মেয়ে পুরুষে পরিশ্রম করে কাজ করতে জানে - শুধু পরিশ্রম করে নয়, পরিপাটি করে -।’
আমেরিকায় কবি এবার গিয়েছেন নোবেলবিজয়ী হিসেবে। কিছু দেখেছেন যেমন, চিত্র-প্রদর্শনী, কোর্ট থিয়েটারে এক বিখ্যাত পোলিশ পিয়ানিস্টের পিয়ানো শুনতে গিয়েছিলেন, কলোরেডোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রভৃতি। কিন্তু ভ্রমণকে উপভোগ করার অবসর তাঁর ছিল না।
পরের বছর আবার আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমন্ত্রণ এলো। আয়োজন শুরু হলেও যাওয়া হলো না। বলেও ছিলেন, ‘যতই যাবার আয়োজন করছি ততই কিন্তু মন বলছে, এবার তোমার যাওয়া হবে না।’ পুজোর সময় গেলেন পিঠাপুরমে, হাঁফিয়ে উঠলেন আলাপ-অভ্যর্থনায়। শুধু ভালো লাগল সঙ্গমেশ্বর শাস্ত্রীর বীণা। সুরেন্দ্রনাথ কর লিখেছেন, ‘সেই বীণকর রাত্রে আহারের পর বারান্দায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বীণা বাজাতেন। গুরুদেব একটা চেয়ারে বসে স্তব্ধ হয়ে শুনতেন তাঁর বীণাবাদন - অনেক রাত পর্যন্ত।’ জানুয়ারি মাসে আবার গেলেন দক্ষিণে ‘পরশু চললুম মৈসুর-মাদ্রাজ-মাদুরায় এবং মদনাপল্লীতে।’ দেখার আগ্রহ ছিল না তা নয় ‘অনেকদিন হইতে মৈসুর রাজ্য দেখিবার ইচ্ছ ছিল।’ যদিও তাঁর প্রথমবারের দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে দেখার কথা বিশেষ নেই। উটি, পালঘাট, সালেম, পিচি, তাঞ্জোর, মাদুরা - সর্বত্র তাঁকে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। বিখ্যাত মন্দিরগুলি সম্ভবত তাঁর দেখা হয়নি। কেননা পারস্যে মসজিদ দেখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মসজিদের প্রাঙ্গণে যাদের দেখলেম তাদের মোল্লার বেশ। নিরুৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখলে, হয়তো মনে মনে প্রসন্ন হয়নি। শুনলুম আর দশ বছর আগে এখানে আমাদের প্রবেশ সম্ভবপর হত না। শুনে আমি যে বিস্মিত হব সে রাস্তা আমার নেই। কারণ আর বিশ বছর পরেও পুরীতে জগন্নাথের মন্দিরে আমার মতো কোনো ব্রাত্য যে প্রবেশ করতে পারবে সে আশা বিড়ম্বনা।’
পুজোর সময় শিলঙে গেলেন। প্রথমে ইচ্ছে ছিল না, পৌঁছাবার পর ‘শিলঙ পাহাড়ে এসে খুব ভালো লাগছে। দার্জিলিঙের চেয়ে অনেক ভালো।... বেশ উজ্জ্বল রৌদ্র দেখা দিয়েছে। আমরা যে জায়গায় আছি এ খুব নিভৃত এবং এখানকার রাস্তাগুলি বেশ নির্জন দেওদার গাছের অবগুণ্ঠনে ঢাকা এবং ছোট নির্ঝরিণীর কলস্বরে মুখরিত। এখানে ছুটির শেষ পর্যন্ত থাকবার ইচ্ছা আছে।’ এসময় কবি শ্রীহট্ট, আগরতলা ও গৌহাটি গিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বোম্বাই যাত্রা করেন অনেক ‘সম্বর্ধনার সমারোহ’ পেরিয়ে, লিখছেন ক্ষিতিমোহন সেন, ‘ঘাট পর্বত পৌঁছিতেই প্রকৃতির গম্ভীর সৌন্দর্যের সাগরে কবিগুরু ডুবিয়া গেলেন।’ আমেদাবাদ কবির পরিচিত শহর, সেখান থেকে গেলেন ভাবনগরে। কাঠিয়াবাড়ের অন্যতম দেশীয় রাজ্য ভাবনগর, রাজ্যের নিজস্ব রেলপথ ছিল, কবির জন্যে স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা হলো। এখানে কবি ভক্তনারীদের কণ্ঠে গাওয়া মীরার ভজন শুনে মুগ্ধ হন।
আবার বিদেশযাত্রা করলেন রবীন্দ্রনাথ। এবারে কবি ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি দেখতে গিয়েছিলেন। ফ্রান্সে এসে অতিথিবৎসল কাহ্নের অতিথিশালায় আশ্রয় নিলেন। বহু বিদগ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলো। একদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক শহর দেখে এসে অ্যান্ডরুজকে লিখলেন, ‘It was a most saddenning sight, some of the terrible damages deliberately done, not for any necessities of war, but to cripple France for ever, were so savage that their memory can never be effected.’ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আমস্টারডামে বক্তৃতা দিতে গেলেন। এখানে এক শিল্পী কবিকে জাভা ও বালির প্রাচীন শিল্পকর্মের ফটো দেখান। ইতিপূর্বে প্যারিসেও অধ্যাপক গোলুবিউ ও অধ্যাপক ফিনো প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে কম্বোডিয়া যাবার কথা বলেন, সেখানকার প্রাচীন মন্দিরের ছবি দেখান। কবিকে প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ছবিগুলি উদ্বুদ্ধ করে।
হল্যান্ড থেকে গেলেন বেলজিয়াম। তারপরে আমেরিকায়। দীর্ঘ সাড়ে চার মাস পরে আবার ইউরোপে ফিরে আসেন। লন্ডনে তিন সপ্তাহ থেকে প্যারিসে গেলেন বিমানে। এই প্রথম কবির বিমানযাত্রা, বিমানটির নাম ছিল গোলিয়েথ, যাত্রী ছিলেন বারোজন। পারস্য যাবার সময় কবি লিখেছিলেন, ‘পূর্বে আর একবার এই পথের পরিচয় পেয়েছিলুম লন্ডন থেকে প্যারিসে।’ স্টকহোমে লোকশিল্প সংগ্রহশালা এবং সুইডিশ লোকোৎসব দেখলেন। ইউরোপে তিনি যখন যেতেন পাশ্চাত্য সংগীত এবং অভিনয় দেখবার চেষ্টা করতেন, উৎকৃষ্ট সংগীত-অভিনয়-নৃত্য-চিত্র-ভাস্কর্য তাঁকে আকৃষ্ট করত। জেনিভা থেকে লুসার্নে গিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন। তাঁর খুব ভালো লেগেছিল লুসার্ন হ্রদে মোটর বোটে ভ্রমণ।
আমন্ত্রণ এলো চীন থেকে। গঙ্গার ঘাটে এসে জাহাজে উঠলেন ‘সেই আমাদের পুরনো গঙ্গাতীর - এই তীর ছেলেবেলায় আমাকে কতদিন কি গভীর আনন্দ দিয়েছে।’ আগের বারে রেঙ্গুন ভালো লাগেনি, এবারো না, তবে বর্মী নৃত্য তাঁর মনোহরণ করল। আর মুগ্ধ হলেন মলয়ের রূপ দেখে, কুয়ালালামপুরের পথে, ‘দুই ধারে কোথাও ঘন অরণ্য, কোথাও রবর গাছের চাষ, মাঝে মাঝে চীনেদের পাড়া কোথাও বা মালয়দের গ্রাম। এত ঘন গাছপালা কোথাও দেখা যায় না... নীল মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন।... যখন শহরের প্রায় কাছাকাছি এসেছি এমন সময় কি ঘোর বৃষ্টি। একেবারে অবিরল ধারা। এমন বৃষ্টি কতদিন দেখিনি।’ সাংহাইয়ে পৌঁছে বক্তৃতা দেবার পরে কবিকে প্রাচীন চীনা নাটক দেখানো হয়। সেখান থেকে পিকিং (বেজিং) যাত্রা করলেন ইয়াংসি নদী পথে। পথে চু-বুতে কনফুসিয়াসের সমাধি দর্শন করলেন। একদিন তিনি দেখলেন নির্বাসিত সম্রাটের ফরবিডন সিটি। সম্রাট কবির সঙ্গে ফটো তুললেন। প্রাসাদ উদ্যান মন্দির-দরবার-বেগম মহল সবই দেখলেন তিনি। কালিদাস নাগ লিখেছেন, ‘এক জায়গায় দুটি গাছ দৃঢ় প্রেম আলিঙ্গনে এক হয়ে গেছে উপরে-নীচে দুই গুঁড়ি। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কবি ছবি তুললেন - ’। একদিন চীনের শিল্পী ও চিত্রকলার সঙ্গে পরিচিত হলেন। তাঁর জন্মদিন পালন করা হলো, চীনের ভক্তরা উপহার আনলেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে কবি এ-দিনটির কথা মনে করে লিখেছেন,
‘একদা গিয়েছি চিন দেশে,
অচেনা সাহারা
ললাটে দিয়েছে চিহ্ন তুমি আমাদের চেনা বলে।’
রবীন্দ্রনাথ চীনে কী কী দেখেছেন সে-বিবরণ স্পষ্ট নয়, তাঁর সহযাত্রীরা অনেক ঘুরেছেন যেমন পইমা স্যু চীনে বৌদ্ধধর্মের আদি কেন্দ্র, লাংসিউয়ে পাহাড়ে ও গুহায় মূর্তি-মন্দির-চৈত্য, প্যাগোডা, বিশাল বুদ্ধমূর্তি, জেড ফাউন্টেন প্রভৃতি দেখেছিলেন। চীনের প্রাচীরের কথা কেউ বলেননি, কবির ভ্রমণে মিশরের পিরামিডও এমনই উল্লেখহীন। এরপর কবি জাপান ঘুরে স্বদেশে ফিরলেন।
জাপানেই কবি দক্ষিণ আমেরিকার পেরু যাবার নিমন্ত্রণ পান সেখানকার শতবার্ষিক উৎসবে যোগ দেবার জন্যে, ‘তাই হালকা হয়ে চলেছি।’ কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর মনে হয়েছে ‘অনেকবার দূরদেশে যাত্রা করেছি, মনের নোঙরটা তুলতে খুব বেশি টানাটানি করতে হয়নি। এবার সে কিছু যেন জোরে ডাঙা অাঁকড়ে আছে। তার থেকে বোধ হচ্ছে, এতদিন পরে আমার বয়স হয়েছে। না-চলতে চাওয়া প্রাণের কৃপণতা, সঞ্চয় কম হলে খরচ করতে সংকোচ হয়।’ এবার কবি নিজেই লিখছেন পশ্চিমাযাত্রী ডায়ারি। রথীন্দ্রনাথও তাঁর সহযাত্রী। তাঁর লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ‘Red sea-তে যেতে যেতে একটা নতুন প্ল্যান মাথায় এসেছে। Port Said-এ এই জাহাজটা ছেড়ে দিয়ে Palestine ও Egypt (বাবার এমনকি Turkeyও ইচ্ছে আছে) ঘুরে সেরে রাখা যেতে পারে।’ কিন্তু তা হয়নি। যদিও জেরুজালেমের মানুষ কবিকে স্বাগত জানাবার জন্যে প্রস্ত্তত হয়েছিল, জানা গেল ঠিক সময়ে ইউরোপে না পৌঁছোলে পেরু যথাসময়ে পৌঁছানো যাবে না। তাই সব পরিকল্পনা বাতিল করে তাঁর ইউরোপযাত্রা করলেন।শেরবুর্গ বন্দর থেকে আন্ডেস জাহাজে যাত্রা শুরু হলো, সঙ্গী ছিলেন এল্মহার্স্ট। এ-জাহাজ কবির ভালো লাগেনি। তিনি লিখলেন, ‘পেরু আমাকে ছাড়তে চাচ্চে না। রেলপথে পর্বত পার হতে ডাক্তারের নিষেধ ছিল তাই আর্জেন্টাইন রাজসরকারের যুদ্ধজাহাজে চড়ে কাল রওনা হবার ব্যবস্থা হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার পুচ্ছদেশ প্রদক্ষিণ করে আটলান্টিক থেকে প্যাসিফিকে উত্তীর্ণ হয়ে সমুদ্র পথে পেরু যেতে হবে। দুই সপ্তাহ লাগবে। পেরুতে যখন যাচ্চি তখন মেক্সিকো যাওয়াও স্থির।’ পরে ঠিক হলো শরীর ভালো থাকলে কবি চিলি হয়ে পেরু যাবেন। বুয়েনোসে আইরেসে গিয়ে উরুগুয়ের চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্রও প্রদর্শনীতে একদিন দেখে এলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের অনুমতি না পেয়ে পেরু যাবার আশা ছেড়ে ইউরোপে ফিরলেন। ইতালির জেনো