19/06/2020
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ৭ উপায়-
করোনা মহামারিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সে অনুযায়ী নিজস্ব ক্ষমতা। যেহেতু এখনও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনকি কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি, সেহেতু ব্যক্তিবিশেষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই ভরসা।
আর এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কোনো একটি নির্দিষ্ট খাবার খেলে বা কাজ করলে রাতারাতি তৈরী হয়ে যায় না। এটা আমাদের সুসমন্বিত জীবন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ফলাফল। পুষ্টি উপাদান বিবেচনায় নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম, অতিরিক্ত উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, ক্ষতিকর অ্যালকোহল ও ধুমপান থেকে বিরত থাকা এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপনি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কার্যকর রাখতে পারেন, বাড়াতে পারেন।
এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটা অনেকটা অর্কেস্ট্রা’র মতো। অর্কেস্ট্রার একটা কাঙ্খিত ও ভালো অনুষ্ঠানের জন্য প্রত্যেকটা বাদ্যযন্ত্রকে সমানতালে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজাতে হয়। কোনো একটা বাদ্যযন্ত্র খারাপ বাজিয়ে আর একটা একটু বেশি ভালো করে কিংবা জোড়ে বাজিয়ে পুরো পারফরমেন্সকে ভালো করা যায় না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও কার্যকর রাখতে দরকার সেরকম কিছু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বা অভ্যাসের সুসমন্বয়। আসুন জেনে নেই সেগুলো সম্পর্কে-
নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবারঃ
স্বাস্থ্যকর খাবার মানে সবদিন সববেলা উন্নতমানের দামি খাবার নয়। খাদ্য উপাদান মেনে সঠিক সময়ে সঠিক মানের খাদ্য গ্রহণ করাটাই স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ। অর্থ্যাৎ শর্করা, প্রোটিন ও চর্বির প্রয়োজনীয় সমন¦য়। মনে রাখতে হবে প্রতিবেলার খাবারে যেনো কোনোভাবেই শর্করার পরিমান ৫০ ভাগের বেশী না হয়। বাকি ৫০ ভাগের মধ্যে চর্বি ৩০ ভাগ ও পোটিন ২০ ভাগ।
প্রোটিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এর এমাইনো এসিড রোগ প্রতিরোধক কোষ তৈরীতে সহায়তা করে। নিয়মিত ডিম, মাছ (সামুদ্রিক মাছ হলে ভালো), চর্বিহীন মাংস (মুরগির মাংস) ও ডাল থেকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন পাওয়া যায়। লাল মাংসে ভালো প্রোটিন পাওয়া যায় না। তাই এটি এড়িয়ে চলতে পারলে অন্য সুবিধাও পাওয়া যাবে।
খাবারের জিংক, ফলিক এসিড, আয়রন, সেলেনিয়াম, কপার, ভিটামিন-এ, সি, ই, বি-৬ এবং বি-১২ উপাদানগুলোতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির গুনাবলী আছে। ভিটামিন-সি এর কথাই ধরুন, যা বেশি পাওয়া যায় লেবু, কিউই, কমলা, পেয়ারা, আমলকী, জাম্বুরা, আমড়া এবং কপি জাতীয় সব্জিতে, এসব খাবারের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরের যে কোনো সংক্রমণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আমাদের শরীর ভিটামিন-সি জমা রাখতে পারে না, তাই এটি প্রতিদিন গ্রহণ করতে হয়। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের প্রতিদিন ৯০ মিলিগ্রাম এবং নারীর ৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি দরকার। তেমনি খাবারের জিঙ্ক রক্তের শ্বেতকণিকার কার্যক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পরিমিত জিঙ্ক পেতে হলে নিয়মিত বাদাম, শিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
উদ্ভিদ জাত বিশেষ করে ফল, সব্জি, ওষধি এবং কিছু মসলা জাতীয় খাবারের পুষ্টি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মলিকিউলার সাইন্সেস-এর এক গবেষনাপত্রে দেখা গেছে মসলা জাতীয় খাবার যেমনঃ লবঙ্গ, পুদিনা পাতা, দারচিনি এবং জিরায় থাকা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী উপাদান খাদ্যের মান ও গুনগত মানও অক্ষুন্ন রাখে।
অতিরিক্ত উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণঃ
অতিরিক্ত ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্বেগ শরীরে স্টেরয়েড হরমোন কর্টিসল এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ক্রমাগত উচ্চ মাত্রার কর্টিসল রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে, ফলে শরীর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে না। কাজেই উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। দরকার হলে ধ্যান কিংবা এমন সব কাজে নিজেকে নিমগ্ন করুন যা আপনার মনে প্রশান্তি আনবে, আপনাকে উৎফুল্ল রাখবে।
পর্যাপ্ত ভালো ঘুমঃ
পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ফিজিওিলজি’র মতে, আমরা যখন ঘুমাই তখন শরীর সাইটোকাইনেজ এবং টি-সেল নিঃসরণ করে। সাইটোকাইনেজ একধরনের প্রোটিন, যা শরীরে যে কোন ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং প্রদাহ উন্নীত করে। অন্যদিকে রক্তের শ্বেতকনিকার ন্যায় টি-সেল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। আর এ কারণেই পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া শরীর খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে পরে এবং সুস্থ হওয়ার যে পর্যায়গুলো আছে তারও গতি মন্থর হয়ে পরে।
ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন এর মতে পূর্নবয়স্ক যে কারো প্রতিদিন অন্তত সাত ঘন্টা ঘুমানো উচিৎ। আর ভালো মানের এই ঘুমের জন্য আপনাকে অন্তত দুই ঘন্টা পূর্বে সরকমের ইলেক্ট্রনিক্স বন্ধ করে দিতে হবে এবং উদ্বেগপূর্ন বই বা আলোচনা এড়িয়ে চলতে হবে।
নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামঃ
নিয়মিত কায়িক শ্রম বা এক্সারসাইজ বা ওয়ার্কআউট যেমনি আপনার দীর্ঘস্থায়ী নানা স্বাস্থ্য সমস্যা যেমনঃ স্থুলতা, ডায়াবেটিস এবং হার্টের সমস্যার ঝুঁকি কমায় তেমনি বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকিও কমায়। নিয়মিত শারীরিক শ্রম বা এক্সারসাইজ মস্তিস্ক থেকে এন্ডোর্ফিন নিঃসরণ ঘটায়, যা উদ্বেগ কমাতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
সিডিসি’র গাইডলাইন অনুযায়ী একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারী প্রবলতার ব্যায়াম যেমনঃ হাটা বা সাইক্লিং কিংবা ৭৫ মিনিট উচ্চ প্রবলতার ব্যায়াম যেমনঃ দৌড়ানো যেতে পারে। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় সেটা একান্তই না পারলে ছাদে হাটা, গ্যারেজে হাটা, বাসার মধ্যে হাটা, চিৎ হয়ে শুয়ে সাইকেলের মতো করে চালানো কিংবা বাসার মধ্যে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজও করা যেতে পারে।
মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনঃ
মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন শরীরের ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অ্যালকোহল রিসার্চ সাময়িকী অনুযায়ী অধিকমাত্রার অ্যালকোহল সেবনের কারণে শরীরের যেকোনো প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা কমে যায় এবং সেড়ে ওঠাও ধীরগতির হয়। দেখা যায়, যারা মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন করেন তারা নিউমোনিয়া, তীব্র শ্বাসতন্ত্রের পীড়া, অ্যালকোহলিক লিভার রোগসহ ক্যান্সারে বেশী ভোগেন অন্যদের তুলনায়।
কাজেই যারা অ্যালকোহল সেবন করেন না, তারা অ্যালকোহল থেকে দুরে থাকুন। আর যারা মাঝেমধ্যে সেবন করেন তারা মাত্রা বজায় রাখুন। এনআইএইচ এর মতে আ্যালকোহলের স্বাস্থ্যসম্মত মাত্রা হলো নারীদের জন্য দৈনিক এক মাত্রা (চার আউন্স সমপরিমান) আর পুরুষের জন্য প্রতিদিন দুই মাত্রা।
ধূমপানকে নাঃ
যে কোনো টক্সিন আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। ধূমপানে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড, নিকোটিন, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং ক্যাডমিয়াম এর মতো রাসায়নিক উপাদানগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলো যেমন: সাইটোকাইনেজ, টি-সেল এবং বি-সেলগুলোকে বেড়ে উঠতে বাধা দেয় এবং সেগুলোর কাজেও ব্যাঘাত ঘটায়।
আমেরিকান সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন এর মতে ধুমপান ফুসফুসের বিভিন্ন ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ (যেমনঃ নিউমোনিয়া, ফ্লু এবং যক্ষা), অস্রোপচার পরবর্তী সংক্রমণ, রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস বা গ্রন্থিপ্রদাহের মতো সমস্যাগুলোর আরো অবনতি করে। কাজেই এখনই ধুমপানকে না বলুন।
দীর্ঘমেয়াদী রোগগুলোর সুনিয়ন্ত্রণঃ
দীর্ঘকাল স্থায়ী রোগ মেমনঃ অ্যাজমা, ডায়াবেটিস এবং হার্টের রোগে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারেন্ট ডায়াবেটিস রিভিউ’স জার্নাল (অক্টোবর ২০১৯) এর মতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীরা যারা তাদের রক্তের সুগার সুনিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, যেকোনো প্রদাহের বিরুদ্ধে সাড়া দেবার ক্ষমতা তাদের কমে যায়। এতে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দূর্বল হয়ে পরে। প্রায় একই ব্যাপার ঘটে অ্যাজমা ও হার্টের সমস্যার বেলায়ও।
আপনার যদি এসব দীর্ঘকাল স্থায়ী রোগগুলোর কোনো একটি বা দুটি থেকে থাকে এবং আপনি যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হন তবে তা থেকে সেড়ে ওঠার জন্য আপনাকে অত্যাধিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কাজেই অ্যাজমা, ডায়াবেটিস এবং হার্টের রোগগুলো সুনিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।
লেখক:
ডা. মোঃ ফজলেরাব্বী খান
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
সেক্রেটারী জেনারেল, হেলদি লিভিং ট্রাস্ট