02/09/2020
আম্মাকে নিয়ে আমাদের পাঁচ ভাইবোনের গোপন মিটিং চলছে। রুদ্ধদ্বার বৈঠক, দোতলায় বড় ভাইয়ার ফ্ল্যাটে। আম্মা এখন সবার মাথা-ব্যথার বড় কারণ। কোন ভাইবোনই এখন আর উনার দেখভালের দায়িত্বটা নিতে আগ্রহী নয়।
অনেকটা বাধ্য হয়েই তাই ভাইবোনদের এই মিটিংটা!আমাদের সবচাইতে ছোটবোন নিপা, মিটিং সফল করতে সবার সাথে যোগাযোগ করেছে। এরই ফলে সব ভাইবোনদের স্ত্রী স্বামী সহ এ মিটিংয়ে উপস্হিতি।
আমার স্ত্রী সোমা মিটিংয়ে আসার আগে পই পই করে আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে। যে করেই হোক আমি যেন মায়ের দেখাশোনার দায়িত্বটা এভয়েড করি। আমার দুই মেয়ে দুজনেই নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আছে। একজন "এ" আর একজন "ও" লেভেলে! ভালো করে এখন ওরা বাংলাই বলতে পারে না! ভীষণ গেঁয়ো আর আনস্মার্ট দাদিকে ওদের একেবারেই অপছন্দ! বন্ধুদের কাছে নাকি উনাকে নিয়ে ওদের প্রেস্টিজ থাকে না!
আর সোমার কাছে মা যেন একটা মূর্তিমান আতঙ্ক। গত মাসে আমাদের বারান্দায় আম্মার পানের পিক ফেলানোর কষ্টটা সোমা এখনোও ভুলতে পারছে না। আমিও আমার স্ত্রী সন্তানদের প্রতি অনেক কেয়ারিং। বাসায় মায়ের উপস্হিতিটাতে আমারও কেন জানি ইদানীং একটু অস্বস্তি হয়। তবে মা যদি দোতলায় ভাইয়া বা তিনতলায় ছোট বোনের বাসায় থাকে, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। পাঁচতলায় উঠানামার পথে, মাঝে মধ্যে খাবার বা শাড়ি-জামা নিয়ে মাকে দেখা করাটা আমার জন্য কোন ব্যাপারই না!
মিটিং শুরু হতেই বুঝতে পেরেছিলাম, প্রত্যেকের যুদ্ধংদেহী মনোভাবটা! সবাই কঠোর প্রস্ততি নিয়ে এসেছে যে-করেই হোক মায়ের দায়িত্বটা এড়িয়ে যাবে। তবে আপনারা যতটা খারাপ ভাবছেন, অতটা খারাপ আমরা কেউই না। বাসায় একসঙ্গে রাখবেন না তবে টাকা-পয়সা বা প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে কারোরই কোনরকম আপত্তি নেই।
আমাদের মা রাহেলা খাতুন। লোকে উনাকে রত্নগর্ভা বলেন। পাঁচ ভাইবোনকে বলতে গেলে এক হাতেই মানুষ করেছেন। আমাদের বাবা শফিকুল হক ব্যস্ত ব্যাংকার ছিলেন। তার উপর নিজের ভাইবোন বা সামাজিক কাজ নিয়েই উনি আজীবন ব্যস্ত ছিলেন! ছেলে মেয়েদের খুব একটা সময় দিতেন না। তবে আব্বা কষ্ট করে খিলগাঁওয়ের এই পাঁচতলা বাড়িটা করে গিয়েছিলেন। আমাদের ভাইবোনদের ঢাকায় থাকার সমস্যাটা সমাধান করে গেছেন বলে আব্বার প্রতি আমরা সব ভাইবোনরাই কৃতজ্ঞ!
আম্মা অবশ্য ছোটবেলা থেকেই আব্বার অভাবটা বেশ ভালোভাবেই পুষিয়ে দিতেন। পাঁচ ভাইবোনের জন্য এমনকি উনি একদিনের জন্যও কখনোই কোথায় বেড়াতে যাননি! খাবার দাবারের জন্যও কখনো আমাদের কোন রকম কমপ্লেন করতে হয়নি। সব কিছু রেডি থাকতো! পড়াশোনার ব্যাপারেও মায়ের ভীষণ আগ্রহ, এক বিন্দুও ছাড় দেননি। গৃহশিক্ষক বা ব্যাচে পড়ার বিষয় তদারকি করতেন কঠোরভাবে।
বড় ভাইয়া যখন বুয়েটে ভর্তি হন, মা প্রথম কিছুদিন রিকশায় করে ভার্সিটিতেও উনাকে দিয়ে আসতেন। এ নিয়ে ভাইয়ার বন্ধুরা এখনো ভাইয়াকে খেপায়! আমার বড়বোন নীপা আপা আর ছোট বোন নীলাকেও রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রতিদিন স্কুল কলেজে নিয়ে গিয়েছেন। নীলা আবার প্রতি শুক্রবার গানের স্কুলেও যেত, তাইতো আম্মা আব্বার সাথে কখনোই ছুটির দুপুরটাও কাটাতে পারেনি। তবে এগুলো নিয়ে আম্মার কখনোই কোন কোন আফসোস নেই, শেষ পযর্ন্ত আমরা ভালোভাবে দাঁড়াতে পেরেছি বলেই।
সবকিছুই ঠিক ছিল। গত বছর আব্বা হঠাৎ করে মারা যাওয়ার পরই বিপত্তির শুরু। আব্বার রিটায়ারমেন্টের পর আম্মার সাথেই উনার জীবন, তিনতলার ফ্ল্যাটটায় দুজনে বেশ ভালো সময় কাটাচ্ছিলেন।
এর মধ্যে বড় ভাইয়া বিয়ে করে দোতলায়, আর বড়আপা চারতলার দখল নিল। আর আমিও সোমাকে বিয়ে করে এ বাড়ির পাঁচতলায় প্রায় দেড় যুগ ধরে। সবচাইতে ছোট ভাই সোহেলও বিয়ে করে এ বাড়ি ছাড়েনি, একতলার দখল নিয়েছে। শুধু ছোট বোন নীলা বিয়ের পর রামপুরায় ওর শশুরবাড়িতে থাকত। এই নীলাও শেষ পযর্ন্ত বাবা-মার তিনতলার দখল নিল, আব্বা মারা যাওয়ার পরপরই।
আব্বা জীবিত থাকতে আমাদের ভাইবোনদের এক সাথে থাকায় কোন সমস্যাই হয়নি। আব্বার নেতৃত্বেই সবকিছু চলত এমনকি এক সাথে গরু কোরবানি দেওয়া। ভাইবোনরা প্রায়ই তিনতলায় বাবা মার ফ্ল্যাটে একসাথে মিলিত হতাম, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছুতোয়। এরপর বটবৃক্ষ বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই পরিবারের বাঁধনটা হালকা হয়ে আসতে লাগল।
মা তখন একা হয়ে পড়লেন, বাসায় আনএটেনডেন্ট অবস্থায় একবার সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার পর পালাক্রমে এখন ভাইবোনদের ফ্ল্যাটে থাকেন। তবে সত্যি বলতে আমরা ভাইবোনরা কেউই আম্মার সাথে থাকার এ বিষয়টি পছন্দ করছি না। তার উপর আম্মা প্রায় সারাবছরই অসুস্থ থাকেন। উনাকে নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ানো, ডাক্তার দেখানো বা সেবা শুশ্রূষা করার মতো সময় আমাদের কারোরই নেই। প্রত্যেকেই এখন নিজ নিজ সংসার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। তাইতো একপ্রকার বাধ্য হয়েই ভাইবোনদের মিটিং ডাকা, গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান খুঁজে বের করতেই।
মিটিংটা শান্তিপূর্ণই ছিল! হঠাৎ করেই ছোটবোন নীলা বড় ভাবির কথাতে রিএক্ট করতেই পরিস্হিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। ভাবি কিন্তু ভালো একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মাকে দেখে শুনে ভালো একটা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো। মাথা মোটা নীলা এটা শুনেই রিএক্ট করলো, ও বলতে চাইছে মা এ বাড়িতেই থাকবে। আর মায়ের দায়িত্বটা নিতে হবে আমাদের তিন ভাইয়ের!
কথাটা শুনে বড়ভাবির পক্ষ নিয়ে ছোটভাই সোহেল নীলাকে ধমক দিতেই পরিস্হিতিটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। আমি অবশ্য আগে থেকেই জানতাম নীলার উপর সোহেলের থাকা ক্ষোভটার কথা! বাবা মার তিনতলার ফ্ল্যাটটার দিকে সোহেলের নজর আগে থেকেই ছিল। নীলা ওর বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে ওটার দখল নিয়ে নিয়েছিল। তাইতো সোহেল সুযোগ পেয়েই নীলাকে অপদস্থ করেছিল।
নীলা, বড় ভাবি, সোহেল আর পরবর্তীকালে আমাদের সবার চিৎকার চেঁচামেচিতে মিটিংটা আর গোপন থাকল না। মা তিনতলা থেকে নেমে দোতলায় আসলেন। সব কথাই শুনলেন আর বুঝলেন! আম্মাকে শুধু দেখেছিলাম কাঁদতে কাঁদতে তিনতলায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে। এরপর কোন রকম সমাধান ছাড়াই মিটিং শেষ করে যে যার ফ্ল্যাটে চলে গেলাম। আম্মার নাকি কান্নাটায় সোমা কেনো, আমি নিজেও খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। উনার জন্যই এখন ভাইবোনদের মধ্যে এসব অহেতুক মনোমালিন্য আর ঝগড়া!
পরদিন সকালে সোমা জানাল আম্মাকে নাকি এ বাসায় আর পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে কিছু না বলেই ভোরে এ বাসা ছেড়ে চলে গেছেন! ভাইয়াকে ফোন করতেই দেখলাম, আম্মার এভাবে চলে যাওয়ায় উনি আমার মতই বিরক্ত, সোহেলও। আম্মার বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে আমরা যে যার মতো অফিসে চলে গেলাম।
লাঞ্চ আওয়ারে সোমা ফোন করে জানাল উকিল আংকেল নাকি বিকেলে আমাদের ভাইবোনদের সাথে কথা বলতে চান। উকিল আংকেল বাবার দূরসম্পর্কের কাজিন, আমাদের পারিবারিক আইনি বিষয় আজীবন উনিই দেখে গেছেন। আর আংকেলই সোমাকে জানিয়েছেন যে, মা এখন জয়পাড়ায় মামাদের বাড়িতে! কথাটা শুনে গুরুত্ব দিলাম না, সারাজীবন মামার বাড়িতেই থাকুকনা আমাদেরকে না জ্বালিয়ে। সোমাও আমার বলা কথাটায় সায় দিয়ে ফোনটা রেখে দিল।
সন্ধ্যায় উকিল আংকেলের কথা শুনে আমাদের সব ভাইবোনদের আক্কেল গুড়ুম। আব্বা মৃত্যুর আগে পুরো বাড়িটা নাকি আম্মাকে লিখে দিয়ে গেছেন। আইনত এই বাড়ির পুরো মালিকানা নাকি এখন একমাত্র আম্মারই! আর সবচাইতে ভয়াবহ সংবাদ, মা নাকি এখন বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উকিল আংকেল এসেছেন আমাদেরকে মায়ের সিদ্ধান্তটা ফর্মালি জানাতে। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করতে বাড়ির নতুন দলিলটাও দেখালেন, রাহেলা খাতুনের নামে।
কথাটা শুনেই আমাদের সব ভাইবোনের মাতৃভক্তি চরমে উঠে গেল! একই সাথে সবাই মাকে ফোন দিতেই, মায়ের ফোন বন্ধ পেলাম। সবাই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম, এমনকি বড় ভাবিটা কাঁদতেও শুরু করে দিলেন। অবাক হলাম আমার স্ত্রী সোমা সবার সামনে ঘোষণা দিল, আম্মা এখন আমাদের সাথেই থাকবে। কিন্তু সোমার প্রস্তাবটা ধোপে টিকল না। বড় ভাবি, সোহেল আর নীলার মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছিল, প্রত্যেকেই এখন মাকে নিজের সাথে রাখতে চায়।
আমি তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিলাম, এখনই জয়পাড়ায় গিয়ে মাকে নিয়ে আসব। সোমাকে চোখ-টিপ দিয়ে পাঁচতলায় নিয়ে আসলে, সেও গোঁ ধরল এই সন্ধ্যায় আমার সাথে জয়পাড়ায় যাবে। আম্মার পানের পিক ফেলানোর কষ্টটা এখন ওর হৃদয় থেকে কর্পূরের মতো উড়ে গেছে। আশ্চর্য হলাম শুনে, আম্মার সাথে বেয়াদবি করলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া দুটো কন্যাকে নাকি এখন থেকে থাপ্পর দেবে বৌ!
তড়িঘড়ি করে নিচে গ্যারেজে আসতে দেখি, ভাইয়া আর আপার গাড়িও রেডি! উনারাও জয়পাড়া যাচ্ছেন মাকে আনতে। আমার গাড়ি স্টার্ট দিতেই দেখি, ছোট দুই ভাইবোন সোহেল আর নীলা এক গাড়িতে, ওরাও বোধ হয় জয়পাড়াই যাচ্ছে।
আমি অবশ্য ওদেরকে কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করে আর সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। আমার আর সোমার দুজনের এখন খুব মন খারাপ। মা সেই ভোর থেকে একা আছে। ডায়বেটিস আর প্রেসারের রোগী! ওষুধটা ঠিকমতো খেয়েছে কিনা? দুপুরেই বা কি খেয়েছে? এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়িতে একটু স্পিড দিলাম। সময় নষ্ট করা যাবে না, না আর এক মুহূর্তের জন্যও না!
মাতৃভক্তি !
লেখা: ইমাম হোসেন