25/02/2019
সুন্দরবন
সুন্দরবনে ( Sundarban) একটি প্রাকৃতিক বিস্ময়ের নাম, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা লবণাক্ত বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সুন্দরবনকে জীব ও উদ্ভিদ জাদুঘর বললেও কম বলা হবে। সুন্দরবনের ১,৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদী-নালা ও বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। রয়েছে বেঙ্গল টাইগার সহ বিচিত্র নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে সুন্দরবন পরিচিত। এখানে রয়েছে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮ উভচর প্রাণী। সুন্দরী বৃক্ষের নাম অনুসারেই এই বনের নাম সুন্দরবন রাখা হয়। সুন্দরবনের ভেতরে যেতে হলে নৌপথেই একমাত্র উপায়। শীতকাল ও বসন্ত কাল সুন্দরবন ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
সুন্দরবনে যা যা দেখার আছে:-
কটকা বিচ:-
সুন্দরবনে যতগুলো বৈচিত্রময় স্থান রয়েছে কাটকা তার মধ্যে অন্যতম। কটকা সী বিচ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। এখানে বেলাভূমি জুড়ে আঁকা থাকে লাল কাঁকড়াদের শিল্পকর্ম। কাটকাতে ৪০ ফুট উচ্চ একটি টাওয়ার আছে যেখান থেকে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। একটি সুন্দর সমুদ্র সৈকত আছে এখানে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হতে ফেরার সময় হেঁটে বীচের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। কাটকা থেকে কাচিখালী (বাঘের জায়গা) পর্যন্ত প্রচুর ঘাস জন্মে বলে অনেক জীবজন্তুর আনাগোনা রয়েছে। এখানে প্রচুর জীবজন্তও দেখা যায়।
কচিখালী:-
বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী। খুলনা, চাঁদপাই এবং শরণখোলা রেঞ্জের মধ্যে কটকা জেটির পাশে ওয়াচ-টাওয়ার সবচেয়ে উঁচু। এখানে উঠলে সামনের খোলা ভূমিতে দেখা যাবে পাল পাল হরিণ।এর ঠিক আগেই রয়েছে একটি মিঠাপানির পুকুর- হরিণ, বাঘ ছাড়াও অন্যান্য বন্যপ্রাণী এখানে জল খেতে আসে।
টাওয়ার থেকে পূবে কটকা-কচিখালী সমুদ্র সৈকতের দিকে যত যাওয়া যাবে- ততই ঘন হয় আসবে বন, সরু হয়ে যাবে ট্রেল।বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী। এদিকটায় হরিণ, বাঁদর যেমন বেশি- তেমন বাঘের সংখ্যাও বেশি। খোলা ভূমির লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে তাই সজাগ দৃষ্টিতে এগুতে হয়। জামতলী হয়ে গহীন বনের ভেতর দিয়ে সরু পথ গিয়ে উঠেছে কটকা সৈকতে। সেখান থেকে বাঁ-দিকে সৈকত ধরে ঘণ্টা দুই হাঁটলে কচিখালী।
এক ঘণ্টার ট্রেলের দু’পাশে কেওড়া, বরই, তাল, অশ্বথ গাছের সারি। মাঝে মাঝে অশ্বথের শেকড় নেমে তৈরি করেছে প্রাকৃতিক দরজা। বনে অভিযানের এমন অনুভূতি তিন রেঞ্জে আর কোথাও পাওয়ার সুযোগ নেই!
তবে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। জেলে, মৌলে, কাঠুরিয়ারা সুন্দরবনে বাঘ, বনদস্যু, জলদস্যুর চেয়ে বেশি ভয় পায় দেও-দানব, ভূত। এ বনে জনশ্রুতি রয়েছে কাউকে একবার বাঘে খেয়ে ফেললে সে ‘বাঘভূত’ হয়ে জন্ম নেয়। তার প্রেতাত্মা জঙ্গলে বাঘের রূপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়- মানুষের অপেক্ষা করে। যদি কোনো মানুষের দেখা পায়, তাহলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে মারতে পারলেই ‘ভূত জন্ম’ থেকে মুক্তি মিলবে। তাই জঙ্গলে মানুষ মধু বা কাঠ আনতে ঢুকলে সেই প্রেতাত্মা মানুষের সুরে অবিকল ডাকতে থাকে। এ জন্য জঙ্গলে কেউ কারও নাম ধরে ডাকে না। ডাকে ‘কু’ বলে। একজন বলবে কু এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন উত্তর দেবে কু। সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে এই বিশ্বাস সবচেয়ে প্রবল।
দুবলার চর:-
সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ যা দুবলার চর নামে হিন্দুধর্মের পূণ্যস্নান, রাসমেলা এবং হরিণের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর।এই চরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, কোকিলমনি, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, মেহের আলির চর এবং শেলার চর নিয়ে দুবলার চর গঠিত। দুবলার চরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।
হিরণ পয়েন্ট:-
সুন্দরবনের দক্ষিণাংশের একটি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। এর আরেক নাম নীলকমল। প্রমত্তা কুঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে, খুলনা রেঞ্জে এর অবস্থান। হিরণ পয়েন্ট ইউনেস্কো ঘোষিত অন্যতম একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। হিরণ পয়েন্ট একটি অভয়ারণ্য হওয়ায় এই স্থান অনেক বাঘ, হরিণ, বানর, পাখি এবং সরিসৃপের নিরাপদ আবসস্থল। সুন্দরবন এলাকায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার অন্যতম একটি স্থান হলো এই হিরণ পয়েন্ট।হিরন পয়েন্টের কাঠের তৈরি সুন্দর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হরিণ, বানর, গুইসাপ ও কুমির দেখতে পাওয়া যায়। এখানে দেখা পাওয়া যায় চিত্রা হরিণ, বন্য শুকরের; পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বুক মাছরাঙা, হলুদ বুক মাছরাঙা, কালোমাথা মাছরাঙা, লার্জ এগ্রেট, কাঁদা খোঁচা, ধ্যানী বক প্রভৃতি। এছাড়া আছে প্রচুর কাঁকড়ার আবাস। আর আছে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি। হিরণ পয়েন্ট থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে কেওড়াসুঠিতে রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার।
মান্দারবাড়িয়া সৈকত:-
মান্দারবাড়ীয়া সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের তীরভূমি জুড়ে ৮ কিলোমিটার লম্বা এক নয়নাভিরাম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত। এখানে একই সাথে বন এবং সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত এর কিছু অংশ এখনো অনাবিষ্কৃত বলে মনে করা হয়। এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়।
জামতলা সৈকত, কটকা:-
এ সৈকত বুনো সুন্দরী। প্রায় তিন কিলোমিটার ঘন সুন্দরী, গেওয়া, গরান, এবং কেওড়ার বন পেরিয়ে সৈকতে যেতে হয়। জামতলা সমুদ্র সৈকতের পথে শুধু ম্যানগ্রোভ বন নয়, বেশ খানিকটা ফার্নের ঝোপও পেরুতে হয়। পথে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারও আছে। পুরো রাস্তায় হরিণের পালের সাথে দেখা হওয়াটাই স্বাভাবিক। অনিন্দ্য সুন্দর এ সৈকত চোরাবালির জন্য কুখ্যাত। সৈকতের নিয়মিত ও আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ ঢেউ নিয়মিত প্রাণ সংহারের কারণ। জামতলা সৈকতে একবারে ১১ জনের মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনাও ঘটেছে।সমুদ্র সৈকতে যেতে যেতে অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনার চোখে পড়বে। সৈকতটির আবার দুইটি ভাগ আছে। একটাতে ঝোপঝাড় বেশি, অন্যটা একটু বেশি খোলামেলা। মাটির স্তুপ করা পলি। ধুয়ে যাওয়া মড়া গাছের শেকড়, সব মিলিয়ে এক অপুর্ব সৌন্দর্য আপনি এই সৈকতে দেখতে পাবেন।
সদা পরিবর্তনশীল ঢেউয়ের প্যাটার্ন ও চোরাবালির জন্য এ সৈকতে না নামাই নিরাপদ। এটি একটি বুনো ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সৈকত। সৌন্দর্য বিবেচনা করলে জামতলা সমুদ্র সৈকত এক কথায় মন-হরণি। বাঘের বিচরণ ভূমি হওয়ায় বাঘ মামার সাথে দেখা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। জামতলা বীচকে অনেকে কটকা বীচ নামেও চেনেন।
ঢাকা থেকে যাওয়ার ব্যবস্থাঃ-
ঢাকা থেকে সরাসরি খুলনা যাওয়ার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ এর ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা থেকে সোহাগ, হানিফ ও ঈগল পরিবহন বাস নিয়মিতভাবে ভোর ৬ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত খুলনার উদ্দেশে যাত্রা করে।ঢাকা থেকে সড়ক পথে খুলনা যেতে প্রায় ৮ ঘন্টা লাগে এবং ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে খুলনা যাবার বিভিন্ন কোম্পানির লঞ্চ রয়েছে।
খুলনা থেকে সুন্দরবন দেখতে হলে ৫০ কিলোমিটার দূরে মংলায় যেতে হবে।খুলনা থেকে মংলা যাওয়ার প্রাইভেট গাড়ি ও বাস রয়েছে। মংলা ঘাট থেকে ট্রলার কিংবা লঞ্চ ভাড়া নিয়ে ২ ঘন্টায় সুন্দরববের করমজল যেতে পারেন।চাইলে সকাল বেলা খুলনা থেকে মংলা হয়ে সুন্দরবন দেখে সন্ধ্যায় খুলনা ফিরে আসতে পারেন।
তবে সুন্দরবন দেখতে যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হচ্ছে কোন ভালো ট্যুর কোম্পানির প্যাকেজ নিয়ে ঘুরতে যাওয়া।যেন কোন সমস্যায় আপনাকে পড়তে না হয়। যেমন বন বিভাগের অনুমতি নেওয়া, সুন্দরবন ভ্রমণ ফি, গাইড, থাকা এবং খাওয়া।
সুন্দরবন ভ্রমণ খরচ:-
অভয়ারণ্য এলাকায় দেশি পর্যটকদের জন্য প্রতিদিনের জনপ্রতি ভ্রমাণ ফি -১৫০ টাকা, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৩০ টাকা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ ফি-১৫০০ টাকা। অভয়ারণ্যের বাইরে দেশি পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ ফি-৭০ টাকা, ছাত্র-ছাত্রী -২০ টাকা, বিদেশিদের জন্য-৩০০ টাকা।
হেলিকপ্টার / সী প্লেনের জন্য এককালীন ফি লাগে ৩০ হাজার টাকা, নবায়ন করতে ফি দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। ১০০ ফুটের ঊর্ধ্বে লঞ্চ এর জন্য ফি দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা, নবায়ন ফি দিতে হয় ৪ হাজার টাকা। ৫০ ফুট থেকে ১০০ ফুট লঞ্চ এর জন্য এককালীন ১০ হাজার টাকা দিতে হয় আর নবায়ন ফি লাগে ৩ হাজার টাকা। ৫০ ফুটের নিচে নৌযানের জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকা ও এদের জন্য নবায়ন ফি লাগে আড়াই হাজার টাকা। সাধারণ ট্রলার ৩ হাজার টাকা ফি-তে সুন্দরবন অবস্থান করতে পারে, এদের নবায়ন ফি ১৫০০ টাকা। স্পিড বোর্ড এর জন্য ফি দিতে হয় ৫ হাজার টাকা, নবায়ন করতে লাগে ২ হাজার টাকা। জালিবোট যেগুলো ট্যুরিস্ট বোট হিসাবে খ্যাত সেগুলোর জন্য এককালীন ফি দিতে হয় ২ হাজার টাকা ও নবায়ন ফি ১ হাজার টাকা লাগে।
বন বিভাগের ভ্রমণ ফি ছাড়াও অন্যান্য খরচের মধ্যে রয়েছে প্রতিদিন গাইড এর জন্য ফি -৫০০ টাকা, নিরাপত্তা গার্ডদের জন্য ফি -৩০০ টাকা, লঞ্চের ক্রুর জন্য ফি -৭০টাকা, টেলিকমিউনিকেশন ফি-২০০ টাকা। ভিডিও ক্যামেরা বাবদ দেশি পর্যটকের ফি দিতে হয়-২০০ টাকা এবং বিদেশি পর্যটকদের ফি দিতে হয়-৩০০ টাকা।
সুন্দরবনে রাস পূর্ণিমার সময় তীর্থযাত্রীদের তিন দিনের জন্য জনপ্রতি ফি দিতে হয় ৫০ টাকা, নিবন্ধনকৃত ট্রলার ফি ২০০ টাকা, অনিবন্ধনকৃত ট্রলার ফি-৮০০ টাকা এবং প্রতিদিন অবস্থানের জন্য ট্রলার ফি- ২০০ টাকা।
সুন্দরবন ভ্রমণ কাল অবশ্যই যা লাগবে:-
১.নিরাপদ খাবার পানির সাথে রাখুন, কারণ সুন্দরবনের খাবার পানির তেমন কোন উৎস নেই।
২.প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখুন।
৩.অভিজ্ঞ একজন ট্যুর অপারেটর এর ব্যবস্থা করুন।
৪.সুন্দরবন ভ্রমনের নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র বন প্রহরী সাথে রাখুন।
আরো অনেক বেশি তথ্যের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন...