28/04/2024
ভারত ভ্রমন (India Tour)
১ম পর্ব - দিল্লি (Delhi)
ভারত এতো বিশাল একটা দেশ যে, কিছু জায়গা ঘুরে এসে ভারত দেখে আসছি বলতে একটু সংকোচ বোধ হচ্ছে। অনেক বৈচিত্র্যময় এক দেশ। এখানে এক এক জায়গার প্রকৃতি আর আবহাওয়া এক এক রকম। এখানে যেমন, মরুভূমি আছে তেমনি বরফ আচ্ছাদিত জায়গা আছে, এক জায়গার ভাষা বাংলা তো অন্য জায়গায় হিন্দি, এ তামিল বলে তো ও পাঞ্জাবি বা মারাঠি। যাই হোক, আমি গত বছর গিয়েছিলাম, দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর, চেন্নাই আর কলকাতা। ছিলাম মোট ২১ দিন। আমাদের সবচেয়ে ভাল লেগেছে জয়পুর আর সবচেয়ে খারাপ সময় কেটেছে কলকাতা।ভবিষ্যতে যাবার ইচ্ছে আছে গোয়া, মুম্বাই, লাদাখ, মানালি, কাশ্মির।
'দিল্লিকা লাড্ডু, জো খায়া ও পস্তায়া, জো নাহি খায়া ও ভি পস্তায়া'। আমাদের ভারত যাত্রা শুরু দিল্লিকা লাড্ডুর সেই দিল্লি দিয়ে। আগেই বলে রাখছি, দিল্লিতে লাড্ডু আছে ঠিকই, কিন্তু এই লাড্ডু সেই দিল্লিকা লাড্ডু না, 'বিয়ে করা' কে দিল্লিকা লাড্ডু নাম দেয়া হয়েছে।
ঢাকা থেকে দিল্লি গিয়েছিলাম এয়ার ইন্ডিয়া তে, ভায়া কলকাতা। ফ্লাইট ছিল রাত ৯টা ৩৫ আর কলকাতায় পৌঁছেছে লোকাল সময় রাত ১০ টায়। কলকাতাতেই ইমিগ্রেশন করতে হয়। তারপর আবার চেক ইন করে ঢুকতে হয়। দিল্লি পর্যন্ত প্লেন ভাড়া ওয়ান ওয়ে জনপ্রতি প্রায় ১৩,০০০ টাকা।
কলকাতাতে প্রায় ৭ ঘন্টা ট্রানজিট ছিল। রাতের বেলা বাইরে না এসে আমরা নিচের তালাতেই একটা লম্বা সিটে শুয়ে বসে অনেক কস্টে কাটিয়ে দিল সময়টা। পরে জানতে পেরেছিলাম, ২ তলাতে বেড ভাড়া নিয়ে রাতে ঘুমানো বা ঝিমানো যায়। 😴
আমি আসার সময় আমার এক কলিগ থেকে তার পুরাতন সিম নিয়ে এসেছিলাম, শুধু রিচার্জ করেছি। সিম দিল্লি যাবার আগেই কলকাতা থেকে কিনা যেতে পারে। দিল্লি এয়ারপোর্টে দাম একটু বেশি নিবে।
কলকাতা থেকে দিল্লি ২ ঘন্টা ১০ মিনিট। ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টে নামলাম সকাল ৭ টা ১০ এ। সেখান থেকে 'ওলা ওলা' করে পাহাড়গঞ্জ এর হোটেল। ভারতে উবার আর ওলাওলার রাজত্ব। এপস ডাউনলোড করে নিয়ে যেতে হবে। পাহাড়গঞ্জ একটু ঘিঞ্জি এলাকা। হোটেল এর ভাড়া তুলনামূলক কম। এয়ারপোর্ট থেকে নতুন বা পুরাতন দিল্লিতে এমআরটিরও লাইন আছে।
ভারতে বিশেষ করে জয়পুরে থাকাকালীন সময়ে আমাদের সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে খাবারের জন্য। সব জায়গায় ভেজ আর ভেজ। খেতে খেতে একসময় নিজেকে গরু-ছাগল মনে হত। দিল্লির পাহাড়গঞ্জ এর হোটেল ছিল বেড উইথ ব্রেকফাস্ট। ব্রেকফাস্টে পরটার সাথে আচার! নাথিং এলস! 🙄 সস্তার তিন অবস্তা শুনেছিলাম, এটা তিন না তিনশ অবস্তা। এরপর থেকে আমরা কাছের অন্য রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতাম। আমরা হোটেল চেঞ্জ করতে চাইলে ওরা ভাড়া আরো কমিয়ে অফার করল, শেষে ওখানেই থেকে গেলাম। অনেক টুরিস্ট ক্যারোল বাগ থাকে। সেখানকার হোটেলের মান ভাল।
কলকাতা বেড়াতে গেলে মনে হয় না বিদেশ গিয়েছি। কিন্তু দিল্লি যেয়ে মনে হল আসলেই বিদেশে এসেছি। অনেককিছুর মধ্যে আমার বেশি ভাল লেগেছে রাস্তার ট্রাফিক শৃঙ্খলা আর মানুষদের ট্রাফিক আইন মানার প্রবনতা।
দিল্লিতে খুবই সুন্দর এমআরটি সিস্টেম আছে। অনেক মানুষ যাতায়াত করে এই এমআরটিতে। এছাড়া অল্প দুরত্বের জন্য অটো আর অধিক দুরত্বের জন্য উবার বা ওলাওলা। আমরা অটোতে হোটেল থেকে নিউ দিল্লি এমআরটি স্টেশনে যেতাম, সেখান থেকে এমআরটি করে বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটে। আমরা মোট ৬ দিন ছিলাম, যা যা দেখলামঃ
★ কুতুব মিনার - এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ইট নির্মিত মিনার। ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দদিন আইবেক এর আদেশে কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। ভারতীয় মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে কুতুব মিনার গুরত্বপূর্ণ। ট্রেনে কুতুব মিনার স্টেশনে নেমে অটোতে রিজার্ভ বা শেয়ারে কুতুব মিনার। এন্ট্রি ফি লোকালদের জন্য ৩০ রুপি আর ফরেনারদের জন্য ৫০০ রুপি। ক্যামেরার জন্য আলাদা টাকা, তবে মোবাইল ক্যামেরা ব্যাবহারে কোন টাকা লাগে নি। অত্যন্ত সুন্দর দর্শনীয় একটা স্পট।
★ রাস্ট্রপতি ভবন ও ইন্ডিয়া গেইট - এই দুইটা স্থাপনা কাছাকাছি দেখালেও অনেক হাঁটতে হবে। ইন্ডিয়া গেইটে বিশেষ করে ছুটির দিনে হাজারো মানুষের সমাগম হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই লোকাল। এটি ভারতের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ১৯৩১ সালে এই সৌধটি নির্মিত হয়। আগে এর নাম ছিল "অল ইন্ডিয়া ওয়ার মনুমেন্ট"। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাদের স্মৃতিরক্ষার্থে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। এটি লাল ও সাদা বেলেপাথর ও গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি।
★ জামে মসজিদ - 'জামে মসজিদ' এমআরটি স্টেশনে নেমে অটো বা হেঁটেই যাওয়া যায়। সেখানে যোহরের নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় তাও পরে নিলাম। মসজিদের ভেতরের সৌন্দর্য বাইরের চেয়ে কম কিছু নয়। অনেক টুরিস্ট আসে এটা দেখার জন্য।
★ লালকেল্লা - লালকেল্লা এমআরটি স্টেশনে নেমে হেঁটেই যাওয়া যায়। অথবা জামে মসজিদ দেখে হেঁটে বা অটোতে লাল কেল্লা যাওয়া যায়।যমুনা নদীর পাড়ে অবস্থিত এই কেল্লার শুরুতেই পরবে এক সারিতে হাতির দল, এদের কারো আবার ৫ টি শুড়। এটি মুঘল সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত একটি দূর্গ। যা পরে ব্রিটিশরা একটি সেনানিবাস হিসেবে ব্যাবহার করে। লালকেল্লার পরিকল্পনা ও সাজসজ্জা শাহজাহানের শাসনকালে মুঘল স্থাপত্য ও চিত্রকলার উৎকর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ফরেনারদের জন্য এন্ট্রি ফি ৫০০ রুপি।
★ লোটাস টেম্পল - লোটাস বা পদ্দফুল আকৃতির একটি মন্দির। বেশ দৃষ্টিনন্দন। কোন এন্ট্রি ফি নেই। এমআরটি তে কাল্কাজি মন্দির স্টেশনে নেমে হেঁটে বা অটোতে যাওয়া যায়। লাস্ট এন্ট্রি ৫ টা ৩০ মিনিট।
★ হুমায়ুনের সমাধি - এন্ট্রি ফি লোকাল ৩০ আর ফরেনার যথারীতি ৫০০ রুপি। ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুনের পত্নী হামিদা বানু এই সমাধিটি নির্মাণ করান। এটির নকশা প্রস্তুত করেছিলেন পারস্য এর স্থপতি মিরাক মির্জা গিয়াস।হুমায়ুনের সমাধিই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম উদ্যান-সমাধিক্ষেত্র।
★ লোদি গার্ডেন - এটা একটা বিশাল জায়গা জুড়ে সিটি পার্ক। সিকান্দার লোদি সহ অনেকের সমাধি আছে এখানে। এটাকে যথাযোগ্যভাবে রক্ষনাবেক্ষন ও করা হয়। সময় কাটানো আর জগিং করার জন্য আদর্শ জায়গা। লোদি গার্ডেন থেকে বের হয়ে একটু হাঁটলেই 'করিম'স ফুড প্লাজা'। সেখানকার সুস্বাদু ননভেজ খাবার অনেক এনজয় করেছি।
বিভিন্ন শপিং এর জন্য যে জায়গাগুলোতে আমরা গিয়েছি -
★ সরজনি মার্কেট - আমাদের নিউমার্কেট বা গাউছিয়ার মতো। স্ট্রিট শপিং। অল্প দামে বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়। পিংক লাইনে সরজনি নগর স্টেশনে নামতে হয়। কেনাকাটার জন্য খুব ভাল একটা জায়গা।
★ দিল্লি হাট - সরজনি নগর থেকে হেঁটে দিল্লি হাট। এখানেও সুলভে জিনিসপত্র পাওয়া যায়। এটা বানিজ্য মেলার মতো একটা মেলা। এন্ট্রি ফি ৪০ রুপি।
★ চাঁদনী চক - এটাও আমাদের গাউছিয়ার মতো মার্কেট, ওল্ড দিল্লিতে। বিশেষ করে কাপড়, বিভিন্ন গৃহসামগ্রী, হার্ডওয়্যার আর হরেক রকম লোকাল খাবার পাওয়া যায়। জিনিসপত্রের দাম অনেক সস্তা কিন্তু অনেক দামাদামি করতে হবে। সরু রাস্তা এবং অনেক ভীড় থাকে। জামে মসজিদ থেকে হেঁটেই আসা যায়। এখানকার স্ট্রিট ফুড অবশ্যই ট্রাই করতে হবে।
★ বিগ বাজার - এটা একটা চেইন শপ। মোটামুটি সবকিছুই সুলভ মূল্যে এক ছাদের নিচে পাওয়া যায়। কাল্কাজি মন্দির স্টেশনের কাছের বিগ বাজারে আমরা গিয়েছিলাম।
★ দি গ্রেট ইন্ডিয়া প্লেস - এমআরটি তে ব্লু লাইন এ নইদা সেক্টর ১৮ এ নেমে কিছুটা হেঁটে বা অটোতে যেতে হবে। এটা ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং মলগুলোর একটি। দেশী এবং বিদেশি রিটেইল শপগুলো এখানে আছে, ফুড কোর্ট আছে। এর খুব কাছেই একটা এমিউজমেন্ট পার্ক আছে, 'ওয়ার্ল্ডস অব ওয়ান্ডার্স '। এন্ট্রি ফি একটু বেশি হলেও বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
★ ডিএলএফ মল - দি গ্রেট ইন্ডিয়া প্লেস এর পাশেই ইন্ডিয়ার আরেকটি বড় শপিং মল। ইন্ডিয়ার মধ্যে ৩য় বৃহত্তর মল। এখানেও অন্যান্য বড় শপিং মলগুলোর মতো সবকিছুই আছে।
★ সিলেক্ট সিটি ওয়াক - ব্রান্ড শপিং এর জন্য এখানে যাওয়া যেতে পারে। এখানে ৫০০ শতাধিক ভারতীয় আর আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের প্রায় ১৮০ টি কাপড় এর দোকান আছে। বেশ কয়েকটি উন্নতমানের ফুড কোর্টও আছে।
খাওয়া-দাওয়াঃ
খাবার আমরা যখন যেখানে পেরেছি সেখানেই খেয়েছি। পান্দারা মার্কেট এর ফুড কোর্ট খাবারের জন্য উল্লেখযোগ্য। এখানের গুলাটি রেস্টুরেন্ট এ অত্যন্ত সুস্বাদু ভেজ খাবার পাওয়া যায়। খাবারের দাম কম বেশি আমাদের দেশের মতোই।
√ আমার অন্যান্য সকল ভ্রমণ কাহিনী পড়তে চাইলে আমার পেজ এ যেতে পারেন।
[আমরা দেশে বিদেশে যেখানেই যাই, আশেপাশের এলাকা নোংরা করব না।]